রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৩

১:০৪:০০ PM
১:০৪:০০ PM

সান্তাল বিদ্রোহের 158 বছর পর বাংলাদেশের সান্তালরা কেমন আছে?

ভাল নেই। একদম ভালো নেই। শিক্ষা, অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সান্তালরা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

উচ্চ শিক্ষা তাদের জন্য সোনার হরিন। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সান্তাল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা নেই। যদিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরবঙ্গের আদিবাসিদের জন্য কোটা আছে, কিন্তু তাও আবার ভাগ বসায় উত্তরবঙ্গের বাইরের ছাত্র-ছাত্রীরা । বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্তাল ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনা করার স্বপ্নই দেখে না।

সরকারী কিংবা বেসরকারী চাকুরি ক্ষেত্রে নূন্যতম সুযোগ সুবিধাই নেই।

1990 সালের পর থেকে বাংলাদেশের সান্তাল জনগোষ্টি আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছে। স্থানীয় ভূমি দূস্য, জোতদার 1855 সালের মত এখনো ক্রিয়াশীল। সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিমুখের মুখে অনেক সান্তাল পরিবার পাড়ি জমিয়েছে ভারতে। কোন সরকারই এই দিকটা দেখেনি বা দেখছে না। যদিও তাদের তকমায় লাগানো আছে, আওয়ামী লীগের ভোটার । কিন্তু গত সাড়ে 4 বছরে সবচেয়ে বেশী আওয়ামী সরকার থেকে সান্তালরা নিগৃহীত হয়েছে । বাংলাদেশের সান্তালদের জন্য দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানা এবং নগাঁও-এর সাপাহারা কিংবা ধামুরইহাট থানা সবচেয়ে বেশী নিরাপত্তাহীন এলাকা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। ঘোড়াঘাট এবং ধামুরইহাটে সান্তাল হত্যাসহ প্রচুর অপরাধ সান্তালদের বিরুদ্ধে ঘটেছে। এই সরকার আসার পর পরই ঘোড়াঘাটে সরকার দলীয় লোকদের ইন্ধনে জমি নিয়ে ৪টি মারামারি. ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এবং বিভিন্ন হুমকি’র ঘটনা ঘটেছে। সান্তালদের বিরুদ্ধে শ’খানেক মামলা হয়েছে। সেই মামলায় এই দুই থানার সান্তালরা দিশেহারা। প্রশাসন নামক রাষ্ট্রযন্ত্র সব সময় নিরব দর্শকের ভুমিকা ধারণ করেছে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি সান্তালদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।

অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসের সুযোগে, স্বার্থনৈষী মহল সবসময় সান্তালদের উপর অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে আসছে।

আধুনিক সমাজে সামাজিকভাবে কতটুকু নিগৃহীত। তা একটি উদাহরনের মাধ্যমে ফুটে উঠে:-
দিনাজপুর জেলায় ঘোড়াঘাট থানায় বিভিন্ন বন্দর, হাটবাজারে, চা কিংবা খাবারের দোকানে এখনও সান্তালদের জন্য আলাদা,ময়লা, ভাঙ্গা কাপ পিরিজ বরাদ্দ আছে। কোন কোন রেস্টুরেন্ট-এ তাদের খাইতেও দেওয়া হয় না।

সান্তাল বিদ্রোহের মত, গৌরবোজ্জল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও আজ তারা সমাজে নিগৃহীত। রাষ্টযন্ত্র তাদের সম্মানীয় নিজেদের নাম পরিবর্তন করে ‘নৃগোষ্টি’ বানায়। বাংলাদেশের সান্তালরা দীর্ঘদিন ধরে নানা বঞ্চনার শিকার। তাদের উপর চলমান নিরব সন্ত্রাস। আজ তারা নিজেদের সম্মানজনক নাম পর্যন্ত হারিয়েছে। তাই বাংলাদেশের সব সান্তাল, নিজেদেরকে ‘সাঁওতাল’ বলতে চায় না। তারা নিজেদেরকে সান্তাল বলে পরিচিত করতে পছন্দ করছে। কারন এই সাঁওতাল শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক বঞ্চনা, গঞ্জনা, নিগৃহীত, ছোট করার বা ছোট করে দেখার অভিপ্রায়। তারা সান্তাল বিদ্রোহের 158 বছর পর আবারো নিজেদেরকে সান্তাল বলে পরিচয় দিতে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ। 

সান্তাল জাতি একটি সম্পূর্ন জাতি। এই জাতির ইতিহাস আছে, এই জাতির সংস্কৃতি আছে, এই জাতির আছে নিজস্ব ভাষা এবং এই জাতিই দাবি করতে পারে, ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম জনগোষ্টি। তাই এই দেশের মাটি, প্রকৃতির সাথে তাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের আত্মিক সম্পর্ক। এই জাতিই একমাত্র জাতি যারা দাবি করতে পারে ‘আদিবাসি’।

সান্তাল বিদ্রোহের 158তম বার্ষিকীতে সমগ্র বাংলাদেশের সান্তালদের একমাত্র দাবি, তাদের ভাষা লেখার জন্য, যে অক্ষরমালা সঠিকভাবে তাদের ভাষা উচ্চারণ করতে পারে, এবং যুগ যুগ ধরে যে অক্ষরমালায় তারা সান্তালি ভাষা শিখে আসছে, লেখাপড়া করে আসছে সেই অক্ষরমালায়ই শিক্ষাদানের উপকরন বানানো হোক।

সান্তালরা আর কোন নতুন নিগৃহীতের শিকার হতে চায় না। তাই সান্তালি অক্ষরমালা অর্থাৎ সম্প্রসারিত রোমান অক্ষরমালায় তাদের শিক্ষার উপকরণ বানানো হোক, এটা তাদের সময়ের দাবি। মহান হুল দিবসের দাবি।

সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৩

৭:৪১:০০ PM

সান্তাল জাতিসত্ত্বা: সবুজ সন্ত্রাসের সহজ শিকার


খোকন সুইটেন মুরমু :


সান্তালদের ভূমি বিক্রির জন্য পৃথক নিয়ম থাকলেও বর্তমান প্রশাসন এই নীতিমালা বাস্তবায়নে অক্ষম। ফলে সন্ত্রাসীরা সদর্পে সান্তালদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদের মত অপকার্য সাধনেও কণ্ঠিত বোধ করছে না। সরকার এবং বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা তথাকতিথ উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে সান্তালদের আরো পিছিয়ে দিচ্ছে এবং সেই সঙ্গে সান্তালদের মধ্যে বপন করছে বিভেদের বীজ। সবুজ সন্ত্রাসের মায়াজালে আচ্ছন্ন  সান্তাল জাতি একবিংশ শতাব্দিতে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি?

বিগ থ্রোট এর মত দেশপ্রেমিকের জন্ম না হলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেত না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার প্রশাসনের নীল নক্শা ফাঁস করে দেয়া এ ভদ্রলোক এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সারাবিশ্বের জনগণের কাছে এক পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। সি.আই.এ ও কে.জি.বি’র মত দাপুটে গোয়েন্দা সংস্থারা সারা বিশ্বের জনগণের কাছে তথ্য গোপন রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতিশয় সত্য কোন ঘটনাকে মিথ্যা এবং মিথ্যা কোন ঘটনাকে সত্য বলে বিশ্ব দরবারে এমনভাবে পরিবেশন করে যে বিশ্ববাসী তাদের মতামতকেই এক সময় সত্য বলে ধরে নেয়। তথ্য দিয়ে সাজানো সত্য ও মিথ্যের এই খেলাই সবুজ সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের দ্বারাই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো পুরো বিশ্বকে শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে তাদের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে সান্তাল সমাজ বিদেশি সাম্প্রদায়িক শক্তি, দেশিয় উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সরকারের কর্ম পরিকল্পনায় অবহেলিত ও বঞ্চিত। সান্তালদের নিয়ে সান্তাল সম্পর্কে অজ্ঞ গবেষণা কর্ম ও দেশিয় উন্নয়ন সহযোগীদের সিদ্ধান্তকে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে। এখানে খতিয়ে দেখার বিষয় হচ্ছে বিদেশি দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত দেশিয় এনজিও সান্তালদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের মূলে সান্তালদের বিভেদকে সর্বদা ত্বরাণি¦ত করছে, উন্নয়ন কিন্তু এখানে গৌণ বিষয়। সান্তালরা বর্তমান উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে তথ্য ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সহজ শিকার। বর্তমানে বাংলাদেশে সান্তালরা ভূমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়মনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। সান্তালদের ভূমি বিক্রির জন্য পৃথক নিয়ম থাকলেও প্রশাসন এই নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নের জন্যে তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করছে না। ফলে সন্ত্রাসীরা সদর্পে সান্তালদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদের মত অপকার্য সাধন করতেও কণ্ঠিত বোধ করছে না। এভাবেই সরকার এবং বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা তথাকতিথ উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে সান্তালদেরকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। সান্তাল জাতি আজ একবিংশ শতাব্দিতে সবুজ সন্ত্রাসের মায়াজালে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি?

বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিযোগিতায় পিছানো কোন জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবী হতে অনগ্রসর জাতিগুলির ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য অহরহ হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন পুকুরের বড় মাছ সেই পুকুরের ছোট মাছগুলিকে খেয়ে ফেলে ঠিক সেভাবেই উন্নত সংস্কৃতি ও ভাষার আক্রমনের স্বীকার হচ্ছে উপমহাদেশের প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতিগুলি। আর্যপূর্ব সান্তাল জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা,কৃষ্টি ও ভাষা আজ সবুজ সন্ত্রাসের বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ।

বিশ্ব দরবারে বাঙালি আজ প্রতিষ্ঠিত। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ বাঙালি জাতি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘মাতৃভাষা বাংলা’কে রক্ষার জন্যে নিজেদের রক্ত দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের চেতনাকে গভীর মমত্ব দিয়ে অন্তরে লালন করে সংগ্রাম করতে শিখেছিল বলেই তারা আজ স্বাধীন। কিন্তু অতন্ত্য পরিতাপের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্বাধীনতা আনলেও আজ দেশের আদিবাসী জনগণ প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। সরকার বদল হয়, আদিবাসীরা আশায় থাকে এবার বুঝি তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলবে কিন্তু আদিবাসী বান্ধব বলে পরিচিত বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামীলীগ সরকার নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারকে উপেক্ষা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর “২৩ক” অনুচ্ছেদে আদিবাসীদেরকে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী” বলে উল্লেখ করেন।
বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দেন যে, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। কিন্তু ক্ষমতার বিপরীত স্রোতে থাকাকালীন সময় বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদিবাসী দিবসে এসে ওয়াদা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তারা আদিবাসীদের সব সমস্যা সমাধান করে দেবেন। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনে সরকার আদিবাসী দিবস পালনকে ২০১৩ সালে প্রশাসনিক ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পোষিত দালাল’রা সেদিন আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে সারা ঢাকা শহরে পোস্টার লাগিয়েছিল। ‘আপনারা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত করুন’ ‘জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত আদিবাসী দিবস বর্জন করুন’ এরকম শ্লোগানে ভর্তি ছিল পোস্টারগুলো। বাংলাদেশে সরকার তার আমলাদেরকে এ ধরনের সমাবেশে যোগদান করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশে করেন। নির্দেশটি অক্ষরে অক্ষরে যে আদিবাসী নেতা ও আমলারাও পালন করেছেন তার প্রমান, মাননীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রি প্রমোদ মানখিন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত আদিবাসী দিবসে আমন্ত্রিত হলেও অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলে থাকাকালীন উনি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ৯ আগষ্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ এর প্রোগ্রামে উপস্থিত থেকে আদিবাসীদের দাবীর প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন।

সারাবিশ্বে আনুমানিক এক কোটির অধিক সান্তাল বসবাস করলেও তাদের কোন পৃথক রাজ্য নেই। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম রাজ্য ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এদের বসবাস অতি প্রাচীনকাল থেকে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে সান্তাল বাঙালিদের আদি পুরুষ। সভ্যতার এই যুগে তাই সান্তালদেরকে সবাই সেই প্রাচীন কালের জংলী মানুষ হিসেবেই ধরে নেয়। অল্পতে তুষ্ট, নিরহ ও শান্তিপ্রিয় এই জাতি তাই কালের বির্বতনে নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছে ক্ষণেক্ষণে। মোঘল, ব্রিটিশ, তুর্কী ও পাঠান সবাই শোষণ করেছে এই জাতিকে। সান্তাল জাতির ললাটে আজও অবিনশ্বর রয়েছে অত্যাচারিত হওয়ার চিহৃটুকু । গর্বভরে সান্তালরা স্মরণ করে তাদের অগ্রজ বীর সিধু-কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন ‘সান্তাল বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আচারনের বিরুদ্ধে। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে সেই বিদ্রোহের সুফল বর্তমানে সান্তালরা ছিটেফোটাও পাচ্ছে না। পশ্চিমারা তাদের ধ্যান-ধারণা উপমহাদেশে প্রচলন করেছিল তাদের স¤্রাজ্যের ভিতকে মজবুত করার জন্য। যদি কেউ মনে করে পশ্চিমা সহচার্য তাদের উন্নত করেছে তাহলে ‘গরু মেরে জুতা দান’ এই উক্তিটি নিজের অজান্তেই হেঁসে উঠবে। কিন্তু ব্রিটিশরা উপমহাদেশকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছে তাদের অনিচ্ছা সত্বেও।

উপমহাদেশের অনেক দেশ এখন ইংরেজিকে নিজেদের মাতৃভাষার মতই শ্রদ্ধাভরে শিখে। কারন বর্তমান সভ্যতার মাপকাঠিতে ইংরেজি ভাষার অবস্থান এখন সবার উপরে। অফিস-আদালত, শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, সংগীত, কৃষি, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই ইংরেজিতে চর্চা করা এখন লক্ষ্যণীয়। কিন্তু সেই ইংরেজকে উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবি শাষকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও ভাষাকে হত্যার প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশের আমজনতা মেনে নেয়নি। এর ফলেই আসে সেই কাঙ্খিত বিজয়। কিন্তু শত বাঙালির ত্যাগ ও স্বাধীনতার মমার্থ আজ নিষ্প্রাণ। বাঙালি জাতি আজ বলতে কুন্ঠিত বোধ করছে যে, তাদের পুর্ব পুরুষ সান্তাল কিংবা মুন্ডা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যদি এটা প্রতিষ্ঠা হয় যে বাঙালিদের রক্তে আর্য ও অনার্যের মিশ্র রক্ত প্রবহমান, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় অনার্য কারা? ‘জনতত্ত্বের সাক্ষ্য অনুসারে এই অঞ্চলে প্রথম আসে খর্বকায় নিগ্রোপ্রতিম মানুষ। আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপ অতিক্রম করে পারস্য উপকূল বেয়ে ধীরে ধীরে এই মানুষেরা বর্তমান ভূখন্ডে বসতি স্থাপন করে’ (ড. সৌমিত্র শেখর; বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা; পৃ: ১৯)। যদি এই কথাটি সত্য হয় তাহলেও সান্তাল এবং মুন্ডারা দাবী করতে পারে তারাই বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের অনার্য। সান্তালরা এই ভূখন্ড পরিযায়ী নয়, কিন্তু অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এটা হতে পারে যে  তারা পরিযায়ী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধীর ২৩(ক) অনুচ্ছেদে সান্তালদেরকে অর্ন্তভূক্ত করে নিজেদের অস্তিত্বকেই ঘোলাটে করে তুলছে। আর যদি সিদ্ধান্তটি সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মানদন্ডের বিচারে হয় তাহলে সান্তাল সমাজ প্রশ্ন রাখে যে, বাঙালির আর্বিভাব কোথা হতে?


বাংলাদেশের সান্তালরা যে আজ সবুজ সন্ত্রাসের সহজ শিকার হচ্ছে, এটা প্রকৃত অর্থে ঘটছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের সুক্ষ্ম ষঢ়যন্ত্রের কারণে। মোঘলরা ভারতীয় উপমহাদেশ দখল করার পর ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করে। মোঘলদের এই ধর্ম প্রচারকে যদি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের সাথে তুলনা করি, তাহলে খুব একটা পার্থক্য পাওয়া যাবে না। এই দুই শাসক শ্রেণির উভয়ের ধর্ম প্রচারের মধ্যে নিহীত ছিল, উপমহাদেশের মানুষের একতা খর্ব করে কিভাবে অধিক সময় শাসনদ- হাতে নিয়ে রাখা যায়। আজ মোঘল ও ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হয়েছে উপমহাদেশীয়রা কিন্তু ধর্মের এই বিভেদ থেকে তারা আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। বাঙালি একটা জাতি হলেও হিন্দু-মুসলমান বিয়ে করে সংসার করা আজ এই স্বাধীন দেশেও সম্ভব নয়। সমাজ এটাকে কখনও মেনে নেবে না। আর ধর্মের দেওয়াল তো এর মধ্যে সদা সর্বদা বিরাজমান। এটা বর্তমানেও সান্তালদের ভাল দিক যে, তারা খ্রিস্টান ও সারনা ধর্মানুসারী হলেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তবে সান্তালীদের পরিষ্কার আকাশে মেঘ হয়ে দেখা দিচ্ছে কিছু মতবাদ। এই মতবাদ প্রণেতারা হচ্ছে সুশীল সমাজের কিছু উচ্চাভিলাষী লোকজন।
উপমহাদেশে বর্তমানে ধর্মীয় ধর্মান্ধতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা কিছু শ্রেণির লোকজনের মধ্যে এখনও বর্তমান। সান্তালদের মধ্যে যে বিভাজন মোঘল কিংবা ব্রিটিশ তৈরি করতে পারেনি, তা আজকে করছে কিছু এন.জি.ও এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই সাথে কিছু বামপন্থি রাজনৈতিক। সান্তালরা আজকে পরিণত হয়েছে গবেষণার কীট হিসেবে। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া যায় না সেটা হচ্ছে, দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ম-লীও এই  হীন কাজে নিজেদেরকে জেনে বা না জেনে সম্পৃক্ত করছে। যে জন্যে সরকার আজকে এশিয়াটিক সোসাইটির মত গবেষণাকেও আমলে নেয় না সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। কিছু বিদেশি এন.জি.ও এবং দাতাসংস্থা উঠে পড়ে লেগেছে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্যে কিন্তু সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ তে শুধু তারা কাজ করতে আগ্রহী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যে আদিবাসীরা আরও উপেক্ষিত তারা তা জেনেও না জানার ভান করে। যে উদ্দেশ্য নিয়েই এসব দাতা সংস্থারা কাজ করুক না কেন, আদিবাসী উন্নয়ন তাদের মূল লক্ষ্য নয়। আর যদি এটা হয় যে বাংলাদেশ সরকার দাতা সংস্থাদেরকে কতিপয় আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চলে কাজ করার জন্যে উৎসাহিত করেন, তাহলে বুঝতে হবে এখানে সরকারের কোন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা আছে। যাই হোক না কেন, সান্তালদের স্বার্থ এখানে দু’ক্ষেত্রেই শূন্য।


কিছু দাতা সংস্থা ও দেশীয় কিছু  এন.জি.ও যেমন ব্র্যাক, প্রশিকা, গণস্বাক্ষরতা অভিযান ইতোমধ্যে সান্তাল শিশুদের জন্য বাংলা হরফে সান্তালী পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। ঊনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে সান্তালদের মধ্যে রোমান হরফে চর্চা চলে আসলেও বর্তমানে এই বিভেদ যেন সান্তালদেরকে বিভাজিত করছে অতিদ্রুত। সান্তাল ছাত্র-ছাত্রীদের যারা ইংরেজি অনুসরণ করে তারা যে কেউ সহজেই রোমান আয়ত্ব করতে পারবে। আলাদাভাবে এর জন্য কোন এন.জি.ও বা দাতাসংস্থার সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতার দরকার নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা’ চালু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। কারণ ইতোপূর্বে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শিক্ষানীতিতে আদিবাসী জনগণের কথাটি বিবেচনায় আনা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জন্য “প্রাক্-প্রাথমিক” শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রচলনের জন্য জোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এরই মধ্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, মুনিপুরি ভাষা দিবস উদ্যাপন শীর্ষক অনুষ্ঠানে বলেছেন- “শিশুকে মায়ের কোলের পর নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার জন্য সরকার প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা শিক্ষানীতির মাধ্যমে চালু করেছে।” কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রণিত মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় সান্তালদের জন্য পুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে রোমান হরফ বিজ্ঞান সম্মত হলেও কিছু মহল বাংলাতে সান্তালী পুস্তক প্রণয়নের জন্যে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সান্তালী ভাষার পুস্তকসমূহ বাংলা লিপিতে প্রণিত হলে কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবি হয়ত গবেষণার উপাত্ত পেয়ে সরকার অথবা এন.জি.ও’র কাছ থেকে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা পাবে এটা পরিস্কার। কিন্তু তাদের চিন্তা করা উচিত এতে সান্তাল জনগণ মোটেও উপকৃত হবে না বরং তারা এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ১৯৭০ সালে ‘অলচিকি’ লিপিতে সান্তালী ভাষায় প্রণিত শিক্ষা কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। রোমান লিপি যে সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য এ ব্যাপারে স্বয়ং মত দিয়েছেন বাংলা ভাষার আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাতত্ত্ববিদ ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি সান্তালী (রোমান হরফ) ও ইংরেজি ভাষায় পি.ও. বোডিং কর্তৃক প্রণিত ৫ খ-ের অভিধান দেখে মন্তব্য করেছিলেন,‘সান্তালী ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য রেভারেন্ড পি.ও. বোডিং সাহেবের নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত থাকবে এবং তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, সান্তালদের সাহিত্যে চর্চার জন্যে রোমান হরফ এর প্রতি যতœবান হওয়া উচিত।’
সরকার কর্তৃক মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমি শিক্ষা চালু হওয়ার পূর্বেই কিছু কিছু দাতা সংস্থার সহযোগিতায় এন.জি.ও সমূহ কিছু সান্তাল লোকজন দিয়ে ভুলভাবে আদিবাসী-বাংলা দ্বিভাষিক শিক্ষা উপকরণ প্রণয়ন শুরু করে দিয়েছেন। এসব এন.জি.ও’র মধ্যে ব্র্যাক, গণশিক্ষা ও প্রশিকা অন্যতম। সরকার সান্তালী ভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় যদি এন.জি.ও এবং কিছু নেতাদের কথায় সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে এটা হবে সান্তালদের শিক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি। সান্তালদের শিক্ষা উপকরণ প্রণয়নের জন্যে ব্যাপকহারে মাঠ পর্যায়ে জনমত জরিপের দরকার আছে বলে মনে করে সান্তালদের জন্য কাজ করে এমন সান্তাল ছাএ সংগঠন। ইতোমধ্যে সান্তালদের নিয়ে ব্যাপকভাবে চিন্তা করে এবং সারা বাংলাদেশের সচেতন কর্মজীবি মহলে পরিচিত সংগঠন ‘বাংলাদেশ সান্তাল কাউনসিল’ মাঠপর্যায়ে জরিপ ও জনমত সংগ্রহ করার জন্যে ২২‘শে ডিসেম্বর, ২০১২ দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে এক প্রেস কন্ফারেন্সের আয়োজন করেছে।

জনমত জরিপ ছাড়া দ্বিভাষী পুস্তক প্রণয়ন যে মারাত্মক ভুল সেটা গণসাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক প্রণিত ‘সাঁওতাল ঐতিহ্যগাথা’ বইটি উদাহরণ হতে পারে। বইটি গণসাক্ষরতা আদিবাসী-বাংলা দ্বিভাষিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্রণয়ন করেছে। বইটি তৈরিতে আর্থিক সহায়তাভাবে করেছে এমবেসি অব দ্যা নেদারল্যান্ডস্, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড কো-অপারেশন এবং অক্সফাম-নভিব, এবং সার্বিকভাবে প্রকাশনায় সাহায্য করেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযান। বইটির লেখক অধ্যাপক গণেশ সরেন ও সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ সরেন (সান্তালী অংশ) প্রকৃতপক্ষেই শিশুদের জন্য সান্তালী জাতির সঠিক ইতিহাস, বীরত্ব, সংগ্রাম ও লোকগাঁথা তুলে ধরতে অক্ষম হয়েছেন। উপরন্তু বইটিতে রয়েছে প্রতি লাইনে বানান ও উচ্চারণে সমস্যা। যেহেতু, বইটির শুরুতেই ভুল আছে সেহেতু বইটির বাংলা অংশের সম্পাদকগণ ভাবানুবাদটুকু সঠিক দিতে পারেননি। ফলে সম্পূর্ণ বইটি বিভিন্ন ধরনের ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা। কোমলমতি সান্তাল শিশুরা বইটি পড়ে সহসাই বাংলা ও সান্তালী উচ্চারণের দ্বিধাদ্বন্দে ভূগবে। ফলে তারা কোনটাই ঠিকমত আয়ত্ব করতে পারবে না। স্কুল থেকেই ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে যেমটি হয়েছে ঐতিহাসিক বর্ষাপাড়ার স্কুলের অবস্থা।

যদিও সেই সময়ে তথাকথিত বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা বাংলা হরফে সান্তালী ভাষা লেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করেছিলেন এবং এনজিও ও দাতা সংস্থা কর্তৃক বাংলা হরফে সান্তালী ভাষা প্রণয়নের সেই বিবেক বর্জিত কাজটি সমর্থন করেছিলেন তা সেই সময়ে ‘আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা: সাওঁতালী ভাষার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আ.ন.স হাবীবুর রহমান এর প্রবন্ধে প্রমাণিত। মি: রহমান তার প্রবন্ধে যে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন তা লক্ষ্যণীয়- “রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বর্ষাপাড়া গ্রামে বঙ্গলিপির মাধ্যমে সাওঁতালী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা সান্তালদের জন্য এক বিপ্লব বয়ে আনবে।” তিনি প্রবন্ধে আরো উল্লেখ করেন যে, “বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে একটিমাত্র অতিরিক্ত চিহ্ন ব্যবহার করা প্রয়োজন আর এটিও বাংলা  ‘ ে ৗ’  চিহ্নের শেষ অংশ ‘ৗ’ কাজেই সাঁওতালি ভাষা কম্প্যুটারে কম্পোজ ’করতেও সমস্যা হচ্ছে না। তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি ভাষা চর্চা করে শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শ্রেণী বাংলাভাষার সকল পাঠ্যপুস্তকে মনোনিবেশ করতে পারবে। তবে, শুরু থেকেই তাদের জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শেখানোর বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমান গবেষণা কর্মসূচিতে প্রশিক্ষা ও ব্র্যাকের কিছু উপকরণ ব্যবহার করায় এই উদ্দেশ্য অনেকটাই সাধিত হচ্ছে।” যদিও গণস্বাক্ষরতা অভিযান এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, গণস্বাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক প্রণিত “সাঁওতাল ঐতিহ্যগাথা” নামক বইয়ের “উপকরণ প্রসঙ্গ” এর চতুর্থ অনুচ্ছেদের উপকরণ প্রসঙ্গের শিরোনামে বলেছেন, ‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান ইতোমধ্যে অনেক অব্যাহত শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন করলেও আদিবাসী বাংলা দ্বিভাষিক উপকরণ উন্নয়নের এটি প্রথম প্রয়াস। আমাদের আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও হয়তো এসব উপকরণে কিছু ভুলভ্রান্তি থেকেই যেতে পারে। এসব ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। এ বিষয়ে আগ্রহী ব্যাক্তি বা সংগঠনের মতামত সাদরে গৃহিত হবে।’ কিন্তু বইটি সর্ম্পকে জানতে চায়লে অধ্যাপক সরেন বিরুপ মনোভাব পোষণ করে বলেন, ‘আমার বাংলা ভাষায় সান্তালী বই লিখতে ইচ্ছে করেছিল বলে আমি লিখেছি, আপনার ইচ্ছে করলে আপনি আপনার মত করে বই লিখেন।’ দ্বিভাষিক পুস্তক প্রণেতা হিসেবে উনার প্রয়োজন জনমত যাচাই করা এবং ফলো-আপ নেয়া বইটি থেকে পাঠক উপকৃত হচ্ছে কিনা, উগ্রভাবে পাঠকের সাথে ব্যবহার করা নয়।

বইটি ইতোমধ্যে সান্তাল সমাজে সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং সামাজিক মিডিয়াতে বইটি বাতিলের দাবী উঠছে। সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন (সাসু) ‘সাওঁতাল ঐতিহ্যগাথা’ বইটি সর্ম্পকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলে, ‘ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং লিপি সেই ভাষাকে সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। কিন্তু কোন ভাষাকে যদি অবৈজ্ঞানিকভাবে ভুল লিপিতে উপস্থাপন করা হয়। সেক্ষেত্রে তা সর্ব সাধারণের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সান্তালী ভাষা হলো এমন ভাষা যা বাংলা হরফ দিয়ে লিখে কিছুটা উচ্চারণ করা গেলেও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ কখনো সম্ভব না। ‘সাসু’ মনে করে বইটির লেখক অধ্যাপক গনেশ সরেন ও সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ সরেন বইটি প্রকাশনার পিছনে কাজ করে নিজেদেরকে কলঙ্কিতই করেছেন। ভাষা একটি স্পর্শকাতর বিষয়, আর এ ভাষা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে ব্যাপকভাবে জনমত গ্রহণ করা দরকার। গণস্বাক্ষরতা অভিযান এর উচিত অবিলম্বে বইটি বাতিল করা নতুবা বইটি বাতিলের দাবীতে বাংলাদেশ সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।
আদিবাসী সান্তালদের উপর শোষকগোষ্ঠী কর্তৃক জুলুম-অত্যাচারের কাহিনী নতুন নয়। দেশে সান্তাল আদিবাসীদেরকে বিভিন্ন কায়দায় জমি থেকে উচ্ছেদ, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নওঁগায় চার সান্তাল খুন, আলফ্রেড সরেনের হত্যা, সেরাফিনা মার্ডীর বিচার এখনও চলমান।  সান্তাল আদিবাসীদেরকে কৌশলে জমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সরকার এখনও সমতলে আদিবাসীদের জন্য কোন পৃথক ল্যান্ড কমিশন গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য রয়েছে পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন। সমতল আদিবাসীদের উপর যে সহিংসতা বাড়ছে তা গত   ৯ আগস্ট ২০১১ দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত পার্থ শঙ্কও সাহা’র ‘আদিবাসীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রতিয়মান- “আদিবাসীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার কোনো আইনি প্রতিকার পাচ্ছেন না আদিবাসীরা। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।” এ বছরের জুলাই পর্যন্ত তিনজন নারীসহ আটজন আদিবাসী খুন হয়েছে। ১০টি ধর্ষনের ঘটনাসহ ২৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত বছর খুন হয়েছিলেন ৩ জন নারীসহ ৭ আদিবাসী। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ২৮টি। আদিবাসীদের পরিচালিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন সুত্রে এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। এ বছরে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে নওঁগায়। জেলার মান্দা উপজেলার চকগোপাল গ্রামে গত ৪ মে খুন হন চারজন আদিবাসী দিনমজুর।”

বাংলাদেশের বর্তমান আদমশুমারীতে সান্তালদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি, উল্টো সান্তালদের দেখানো হয়েছে যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। বাংলাদেশের আদমশুমারী ২০১১ এর মতে সান্তালদের সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ১১২, যা মোটেও সত্য নয়। গত ২৭ আগস্ট, ২০১১ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় শিশির মোড়ল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- “৪৭ জেলায় আদিবাসীর সংখ্যা কমেছে !’ শীর্ষক প্রতিবেদন হতে প্রতিয়মান হয় যে,  বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের সঠিক জনসংখ্যা সংরক্ষণে যত্নবান নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- “উত্তরের জেলা নওঁগায় ২৪ হাজার ৪০৯ জন চাকমা বাস করে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতা অথবা এদের বিষয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যাক্তিরা বলেছেন, এটা ভুল তথ্য হাস্যকর। চাকমাদের বসবাসের স্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম, নওঁগা নয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রথম আলোকে বলেন,‘এই আদমশুমারির তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোন অর্থ বহন করে না। ৪৭টি জেলায় কেন আদিবাসী মানুষ কমেছে এর ব্যাখ্যা পরিসংখ্যান ব্যুরোকে দিতে হবে। সংখ্যা কম দেখানো অর্থ রাষ্ট্র কর্তৃক আমাদের অধিকার অস্বীকার করা। আদিবাসীদের সংখ্যা যত কম দেখানো যাবে, সরকারের দায়িত্বও তত কম থাকবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ‘আদমশুমারি ও গৃহ গণনা ২০১১’ প্রকল্পের পরিচালক অসীম কুমার দে বলেন- ‘মাঠপর্যায়ের গণনাকারীরা যে তথ্য পেয়েছেন, আমরা সেই তথ্য প্রকাশ করেছি।’ সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে সাঁওতাল। এদের সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ১১২ জন। সাঁওতালেরা প্রধানত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বাস করে। রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, সারা দেশে সাঁওতালদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের হিসেবে সারা দেশে প্রায় পাঁচ লাখ সাঁওতাল বাস করে। ফিলিপ গাইনও বলেছেন, একাধিক জরিপ অনুযায়ী দেশে সাঁওতালদের সংখ্যা চার লাখ বা তারও বেশী।”


বিশ্বায়নের এ যুগে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর জোটসমূহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আরেপিত  মতবাদের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে এডিবি, আইএমএফ এবং সর্বোপুরি বিশ্বব্যাংক এর মত আগ্রাসি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শোষণ করে থাকে। এসব আগ্রাসি প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে তাদের আরোপিত শর্তসমূহ অনুসারে পরিচালনা করছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত বিশ্বের এসব তথাকথিত সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন শর্তানুযায়ী সর্বদাই জিম্মি। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমুহ তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ সব সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানের মতামতকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলশ্রতিতে সরকার সব বিদেশি প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে, জাতিসংঘ কর্তৃ ক পরিচালিত ইউএনডিপি কালচারাল প্রজেক্ট বাংলাদেশের আদিবাসীদের কৃষ্টি ও কালচারকে ‘কালচারাল প্রমোশনাল এক্টিভিটিস’ এর নামে বিরূপভাবে বিশ্ব দরবারে আদিবাসীদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করছে ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ এই শিরোনামের আওতায়। ফলে আদিবাসীরা নিজ সংস্কৃতি হতে ক্রমান্বয়ে বিচ্যূত হচ্ছে। বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মপন্থার মায়াজালে আদিবাসীদেরকে অর্ন্তভূক্ত করে তাদেরকে আরও কৌশলে  পিছিয়ে দিচ্ছে। সান্তাল জাতি এসব বিদেশি দাতাসংস্থার দ্বারা পরিচালিত দেশিয় এনজিও, তথাকথিত সুশিল সমাজের লেবাসধারী বুদ্ধিজীবী, সান্তাল না হওয়া সত্বেও সান্তালী ভাষার গবেষক হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ও কতিপয় সুবিধাবাদী আদিবাসী সংগঠনসমুহের কাছে জিম্মি। একবিংশ শতাব্দিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন সারাবিশ্বে প্রবাহমান। সচেতন সান্তাল সমাজ  এসব দেশিয় দোসর, উন্নয়নের নামে পরিচালিত এনজিও, বিদেশি দাতা সংস্থা সর্বোপরি সান্তালদের স্বার্থ বিরোধী সরকারের কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিবে না। কৌশলগত মারপ্যাচের জালে আবিষ্ট সান্তাল যুব সমাজ এখন বিদেশি প্রভুদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সরকারের যেকোন চাপিয়ে দেয়া সূক্ষ্ম মতবাদ (সবুজ সন্ত্রাস) কে ভবিষতে যেকোন মূল্যে প্রতিহত করবে ।

(লেখাটি সান্দেস ইস্যু 24, বছর 18, 2012 তে প্রকাশিত)

লেখক পরিচিতি: খোকন সুইটেন মূমূ
ঢাকা 
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি এনজিওতে কর্মরত এবং ফ্রিল্যান্সার লেখক ও গবেষক
৭:৪১:০০ PM

সান্তাল জাতিসত্ত্বা: সবুজ সন্ত্রাসের সহজ শিকার


খোকন সুইটেন মুরমু :


সান্তালদের ভূমি বিক্রির জন্য পৃথক নিয়ম থাকলেও বর্তমান প্রশাসন এই নীতিমালা বাস্তবায়নে অক্ষম। ফলে সন্ত্রাসীরা সদর্পে সান্তালদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদের মত অপকার্য সাধনেও কণ্ঠিত বোধ করছে না। সরকার এবং বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা তথাকতিথ উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে সান্তালদের আরো পিছিয়ে দিচ্ছে এবং সেই সঙ্গে সান্তালদের মধ্যে বপন করছে বিভেদের বীজ। সবুজ সন্ত্রাসের মায়াজালে আচ্ছন্ন  সান্তাল জাতি একবিংশ শতাব্দিতে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি?

বিগ থ্রোট এর মত দেশপ্রেমিকের জন্ম না হলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি প্রকাশ পেত না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার প্রশাসনের নীল নক্শা ফাঁস করে দেয়া এ ভদ্রলোক এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সারাবিশ্বের জনগণের কাছে এক পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। সি.আই.এ ও কে.জি.বি’র মত দাপুটে গোয়েন্দা সংস্থারা সারা বিশ্বের জনগণের কাছে তথ্য গোপন রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতিশয় সত্য কোন ঘটনাকে মিথ্যা এবং মিথ্যা কোন ঘটনাকে সত্য বলে বিশ্ব দরবারে এমনভাবে পরিবেশন করে যে বিশ্ববাসী তাদের মতামতকেই এক সময় সত্য বলে ধরে নেয়। তথ্য দিয়ে সাজানো সত্য ও মিথ্যের এই খেলাই সবুজ সন্ত্রাস। এই সন্ত্রাসের দ্বারাই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো পুরো বিশ্বকে শোষণের বেড়াজালে আবদ্ধ রেখে তাদের শোষণ অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে সান্তাল সমাজ বিদেশি সাম্প্রদায়িক শক্তি, দেশিয় উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও সরকারের কর্ম পরিকল্পনায় অবহেলিত ও বঞ্চিত। সান্তালদের নিয়ে সান্তাল সম্পর্কে অজ্ঞ গবেষণা কর্ম ও দেশিয় উন্নয়ন সহযোগীদের সিদ্ধান্তকে সরকার প্রাধান্য দিচ্ছে। এখানে খতিয়ে দেখার বিষয় হচ্ছে বিদেশি দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত দেশিয় এনজিও সান্তালদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের মূলে সান্তালদের বিভেদকে সর্বদা ত্বরাণি¦ত করছে, উন্নয়ন কিন্তু এখানে গৌণ বিষয়। সান্তালরা বর্তমান উপমহাদেশে বিভিন্ন দেশে তথ্য ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের সহজ শিকার। বর্তমানে বাংলাদেশে সান্তালরা ভূমি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের নিয়মনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। সান্তালদের ভূমি বিক্রির জন্য পৃথক নিয়ম থাকলেও প্রশাসন এই নীতিমালাগুলো বাস্তবায়নের জন্যে তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহন করছে না। ফলে সন্ত্রাসীরা সদর্পে সান্তালদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদের মত অপকার্য সাধন করতেও কণ্ঠিত বোধ করছে না। এভাবেই সরকার এবং বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা তথাকতিথ উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান উন্নয়নের নামে সান্তালদেরকে আরো পিছিয়ে দিচ্ছে। সান্তাল জাতি আজ একবিংশ শতাব্দিতে সবুজ সন্ত্রাসের মায়াজালে নিজেদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি?

বিশ্বায়নের এ যুগে প্রতিযোগিতায় পিছানো কোন জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। বিশ্বায়নের প্রভাবে পৃথিবী হতে অনগ্রসর জাতিগুলির ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য অহরহ হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন পুকুরের বড় মাছ সেই পুকুরের ছোট মাছগুলিকে খেয়ে ফেলে ঠিক সেভাবেই উন্নত সংস্কৃতি ও ভাষার আক্রমনের স্বীকার হচ্ছে উপমহাদেশের প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতিগুলি। আর্যপূর্ব সান্তাল জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা,কৃষ্টি ও ভাষা আজ সবুজ সন্ত্রাসের বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ।

বিশ্ব দরবারে বাঙালি আজ প্রতিষ্ঠিত। এটা সম্ভব হয়েছে কারণ বাঙালি জাতি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ ও ‘মাতৃভাষা বাংলা’কে রক্ষার জন্যে নিজেদের রক্ত দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের চেতনাকে গভীর মমত্ব দিয়ে অন্তরে লালন করে সংগ্রাম করতে শিখেছিল বলেই তারা আজ স্বাধীন। কিন্তু অতন্ত্য পরিতাপের বিষয় যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে স্বাধীনতা আনলেও আজ দেশের আদিবাসী জনগণ প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতে পারছে না। সরকার বদল হয়, আদিবাসীরা আশায় থাকে এবার বুঝি তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিলবে কিন্তু আদিবাসী বান্ধব বলে পরিচিত বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামীলীগ সরকার নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারকে উপেক্ষা করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর “২৩ক” অনুচ্ছেদে আদিবাসীদেরকে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী” বলে উল্লেখ করেন।
বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দেন যে, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। কিন্তু ক্ষমতার বিপরীত স্রোতে থাকাকালীন সময় বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদিবাসী দিবসে এসে ওয়াদা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তারা আদিবাসীদের সব সমস্যা সমাধান করে দেবেন। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনে সরকার আদিবাসী দিবস পালনকে ২০১৩ সালে প্রশাসনিক ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক পোষিত দালাল’রা সেদিন আদিবাসীদের উদ্দেশ্যে সারা ঢাকা শহরে পোস্টার লাগিয়েছিল। ‘আপনারা নিজেদেরকে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত করুন’ ‘জাতিসংঘ কর্তৃক আরোপিত আদিবাসী দিবস বর্জন করুন’ এরকম শ্লোগানে ভর্তি ছিল পোস্টারগুলো। বাংলাদেশে সরকার তার আমলাদেরকে এ ধরনের সমাবেশে যোগদান করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশে করেন। নির্দেশটি অক্ষরে অক্ষরে যে আদিবাসী নেতা ও আমলারাও পালন করেছেন তার প্রমান, মাননীয় সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রি প্রমোদ মানখিন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত আদিবাসী দিবসে আমন্ত্রিত হলেও অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলে থাকাকালীন উনি জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ৯ আগষ্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ এর প্রোগ্রামে উপস্থিত থেকে আদিবাসীদের দাবীর প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন।

সারাবিশ্বে আনুমানিক এক কোটির অধিক সান্তাল বসবাস করলেও তাদের কোন পৃথক রাজ্য নেই। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম রাজ্য ছাড়াও নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এদের বসবাস অতি প্রাচীনকাল থেকে। নৃবিজ্ঞানীদের মতে সান্তাল বাঙালিদের আদি পুরুষ। সভ্যতার এই যুগে তাই সান্তালদেরকে সবাই সেই প্রাচীন কালের জংলী মানুষ হিসেবেই ধরে নেয়। অল্পতে তুষ্ট, নিরহ ও শান্তিপ্রিয় এই জাতি তাই কালের বির্বতনে নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছে ক্ষণেক্ষণে। মোঘল, ব্রিটিশ, তুর্কী ও পাঠান সবাই শোষণ করেছে এই জাতিকে। সান্তাল জাতির ললাটে আজও অবিনশ্বর রয়েছে অত্যাচারিত হওয়ার চিহৃটুকু । গর্বভরে সান্তালরা স্মরণ করে তাদের অগ্রজ বীর সিধু-কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন ‘সান্তাল বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আচারনের বিরুদ্ধে। একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে সেই বিদ্রোহের সুফল বর্তমানে সান্তালরা ছিটেফোটাও পাচ্ছে না। পশ্চিমারা তাদের ধ্যান-ধারণা উপমহাদেশে প্রচলন করেছিল তাদের স¤্রাজ্যের ভিতকে মজবুত করার জন্য। যদি কেউ মনে করে পশ্চিমা সহচার্য তাদের উন্নত করেছে তাহলে ‘গরু মেরে জুতা দান’ এই উক্তিটি নিজের অজান্তেই হেঁসে উঠবে। কিন্তু ব্রিটিশরা উপমহাদেশকে অনেক কিছুই দিয়ে গেছে তাদের অনিচ্ছা সত্বেও।

উপমহাদেশের অনেক দেশ এখন ইংরেজিকে নিজেদের মাতৃভাষার মতই শ্রদ্ধাভরে শিখে। কারন বর্তমান সভ্যতার মাপকাঠিতে ইংরেজি ভাষার অবস্থান এখন সবার উপরে। অফিস-আদালত, শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কলা, সংগীত, কৃষি, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই ইংরেজিতে চর্চা করা এখন লক্ষ্যণীয়। কিন্তু সেই ইংরেজকে উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাবি শাষকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও ভাষাকে হত্যার প্রচেষ্টাকে বাংলাদেশের আমজনতা মেনে নেয়নি। এর ফলেই আসে সেই কাঙ্খিত বিজয়। কিন্তু শত বাঙালির ত্যাগ ও স্বাধীনতার মমার্থ আজ নিষ্প্রাণ। বাঙালি জাতি আজ বলতে কুন্ঠিত বোধ করছে যে, তাদের পুর্ব পুরুষ সান্তাল কিংবা মুন্ডা। বাংলাদেশের ইতিহাসে যদি এটা প্রতিষ্ঠা হয় যে বাঙালিদের রক্তে আর্য ও অনার্যের মিশ্র রক্ত প্রবহমান, তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় অনার্য কারা? ‘জনতত্ত্বের সাক্ষ্য অনুসারে এই অঞ্চলে প্রথম আসে খর্বকায় নিগ্রোপ্রতিম মানুষ। আফ্রিকা থেকে আরব উপদ্বীপ অতিক্রম করে পারস্য উপকূল বেয়ে ধীরে ধীরে এই মানুষেরা বর্তমান ভূখন্ডে বসতি স্থাপন করে’ (ড. সৌমিত্র শেখর; বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা; পৃ: ১৯)। যদি এই কথাটি সত্য হয় তাহলেও সান্তাল এবং মুন্ডারা দাবী করতে পারে তারাই বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের অনার্য। সান্তালরা এই ভূখন্ড পরিযায়ী নয়, কিন্তু অন্য কোন জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এটা হতে পারে যে  তারা পরিযায়ী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধীর ২৩(ক) অনুচ্ছেদে সান্তালদেরকে অর্ন্তভূক্ত করে নিজেদের অস্তিত্বকেই ঘোলাটে করে তুলছে। আর যদি সিদ্ধান্তটি সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মানদন্ডের বিচারে হয় তাহলে সান্তাল সমাজ প্রশ্ন রাখে যে, বাঙালির আর্বিভাব কোথা হতে?


বাংলাদেশের সান্তালরা যে আজ সবুজ সন্ত্রাসের সহজ শিকার হচ্ছে, এটা প্রকৃত অর্থে ঘটছে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের সুক্ষ্ম ষঢ়যন্ত্রের কারণে। মোঘলরা ভারতীয় উপমহাদেশ দখল করার পর ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার ও প্রসার করে। মোঘলদের এই ধর্ম প্রচারকে যদি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের সাথে তুলনা করি, তাহলে খুব একটা পার্থক্য পাওয়া যাবে না। এই দুই শাসক শ্রেণির উভয়ের ধর্ম প্রচারের মধ্যে নিহীত ছিল, উপমহাদেশের মানুষের একতা খর্ব করে কিভাবে অধিক সময় শাসনদ- হাতে নিয়ে রাখা যায়। আজ মোঘল ও ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হয়েছে উপমহাদেশীয়রা কিন্তু ধর্মের এই বিভেদ থেকে তারা আজও বের হয়ে আসতে পারেনি। বাঙালি একটা জাতি হলেও হিন্দু-মুসলমান বিয়ে করে সংসার করা আজ এই স্বাধীন দেশেও সম্ভব নয়। সমাজ এটাকে কখনও মেনে নেবে না। আর ধর্মের দেওয়াল তো এর মধ্যে সদা সর্বদা বিরাজমান। এটা বর্তমানেও সান্তালদের ভাল দিক যে, তারা খ্রিস্টান ও সারনা ধর্মানুসারী হলেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তবে সান্তালীদের পরিষ্কার আকাশে মেঘ হয়ে দেখা দিচ্ছে কিছু মতবাদ। এই মতবাদ প্রণেতারা হচ্ছে সুশীল সমাজের কিছু উচ্চাভিলাষী লোকজন।
উপমহাদেশে বর্তমানে ধর্মীয় ধর্মান্ধতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা কিছু শ্রেণির লোকজনের মধ্যে এখনও বর্তমান। সান্তালদের মধ্যে যে বিভাজন মোঘল কিংবা ব্রিটিশ তৈরি করতে পারেনি, তা আজকে করছে কিছু এন.জি.ও এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই সাথে কিছু বামপন্থি রাজনৈতিক। সান্তালরা আজকে পরিণত হয়েছে গবেষণার কীট হিসেবে। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া যায় না সেটা হচ্ছে, দেশের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ম-লীও এই  হীন কাজে নিজেদেরকে জেনে বা না জেনে সম্পৃক্ত করছে। যে জন্যে সরকার আজকে এশিয়াটিক সোসাইটির মত গবেষণাকেও আমলে নেয় না সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। কিছু বিদেশি এন.জি.ও এবং দাতাসংস্থা উঠে পড়ে লেগেছে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্যে কিন্তু সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ তে শুধু তারা কাজ করতে আগ্রহী। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যে আদিবাসীরা আরও উপেক্ষিত তারা তা জেনেও না জানার ভান করে। যে উদ্দেশ্য নিয়েই এসব দাতা সংস্থারা কাজ করুক না কেন, আদিবাসী উন্নয়ন তাদের মূল লক্ষ্য নয়। আর যদি এটা হয় যে বাংলাদেশ সরকার দাতা সংস্থাদেরকে কতিপয় আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চলে কাজ করার জন্যে উৎসাহিত করেন, তাহলে বুঝতে হবে এখানে সরকারের কোন দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা আছে। যাই হোক না কেন, সান্তালদের স্বার্থ এখানে দু’ক্ষেত্রেই শূন্য।


কিছু দাতা সংস্থা ও দেশীয় কিছু  এন.জি.ও যেমন ব্র্যাক, প্রশিকা, গণস্বাক্ষরতা অভিযান ইতোমধ্যে সান্তাল শিশুদের জন্য বাংলা হরফে সান্তালী পুস্তক প্রণয়ন করেছেন। ঊনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে সান্তালদের মধ্যে রোমান হরফে চর্চা চলে আসলেও বর্তমানে এই বিভেদ যেন সান্তালদেরকে বিভাজিত করছে অতিদ্রুত। সান্তাল ছাত্র-ছাত্রীদের যারা ইংরেজি অনুসরণ করে তারা যে কেউ সহজেই রোমান আয়ত্ব করতে পারবে। আলাদাভাবে এর জন্য কোন এন.জি.ও বা দাতাসংস্থার সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতার দরকার নেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা’ চালু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। কারণ ইতোপূর্বে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের শিক্ষানীতিতে আদিবাসী জনগণের কথাটি বিবেচনায় আনা হয়নি। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষানীতিতে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার জন্য “প্রাক্-প্রাথমিক” শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রচলনের জন্য জোর কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। এরই মধ্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, মুনিপুরি ভাষা দিবস উদ্যাপন শীর্ষক অনুষ্ঠানে বলেছেন- “শিশুকে মায়ের কোলের পর নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা দেয়ার জন্য সরকার প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা শিক্ষানীতির মাধ্যমে চালু করেছে।” কিন্তু বর্তমান সরকারের প্রণিত মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় সান্তালদের জন্য পুস্তক প্রণয়নের ক্ষেত্রে রোমান হরফ বিজ্ঞান সম্মত হলেও কিছু মহল বাংলাতে সান্তালী পুস্তক প্রণয়নের জন্যে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

সান্তালী ভাষার পুস্তকসমূহ বাংলা লিপিতে প্রণিত হলে কিছু বাঙালি বুদ্ধিজীবি হয়ত গবেষণার উপাত্ত পেয়ে সরকার অথবা এন.জি.ও’র কাছ থেকে গবেষণার সুযোগ-সুবিধা পাবে এটা পরিস্কার। কিন্তু তাদের চিন্তা করা উচিত এতে সান্তাল জনগণ মোটেও উপকৃত হবে না বরং তারা এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ১৯৭০ সালে ‘অলচিকি’ লিপিতে সান্তালী ভাষায় প্রণিত শিক্ষা কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। রোমান লিপি যে সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য এ ব্যাপারে স্বয়ং মত দিয়েছেন বাংলা ভাষার আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাষাতত্ত্ববিদ ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি সান্তালী (রোমান হরফ) ও ইংরেজি ভাষায় পি.ও. বোডিং কর্তৃক প্রণিত ৫ খ-ের অভিধান দেখে মন্তব্য করেছিলেন,‘সান্তালী ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য রেভারেন্ড পি.ও. বোডিং সাহেবের নাম স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত থাকবে এবং তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, সান্তালদের সাহিত্যে চর্চার জন্যে রোমান হরফ এর প্রতি যতœবান হওয়া উচিত।’
সরকার কর্তৃক মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমি শিক্ষা চালু হওয়ার পূর্বেই কিছু কিছু দাতা সংস্থার সহযোগিতায় এন.জি.ও সমূহ কিছু সান্তাল লোকজন দিয়ে ভুলভাবে আদিবাসী-বাংলা দ্বিভাষিক শিক্ষা উপকরণ প্রণয়ন শুরু করে দিয়েছেন। এসব এন.জি.ও’র মধ্যে ব্র্যাক, গণশিক্ষা ও প্রশিকা অন্যতম। সরকার সান্তালী ভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় যদি এন.জি.ও এবং কিছু নেতাদের কথায় সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে এটা হবে সান্তালদের শিক্ষার জন্য মারাত্মক হুমকি। সান্তালদের শিক্ষা উপকরণ প্রণয়নের জন্যে ব্যাপকহারে মাঠ পর্যায়ে জনমত জরিপের দরকার আছে বলে মনে করে সান্তালদের জন্য কাজ করে এমন সান্তাল ছাএ সংগঠন। ইতোমধ্যে সান্তালদের নিয়ে ব্যাপকভাবে চিন্তা করে এবং সারা বাংলাদেশের সচেতন কর্মজীবি মহলে পরিচিত সংগঠন ‘বাংলাদেশ সান্তাল কাউনসিল’ মাঠপর্যায়ে জরিপ ও জনমত সংগ্রহ করার জন্যে ২২‘শে ডিসেম্বর, ২০১২ দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে এক প্রেস কন্ফারেন্সের আয়োজন করেছে।

জনমত জরিপ ছাড়া দ্বিভাষী পুস্তক প্রণয়ন যে মারাত্মক ভুল সেটা গণসাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক প্রণিত ‘সাঁওতাল ঐতিহ্যগাথা’ বইটি উদাহরণ হতে পারে। বইটি গণসাক্ষরতা আদিবাসী-বাংলা দ্বিভাষিক শিক্ষা উপকরণ হিসেবে প্রণয়ন করেছে। বইটি তৈরিতে আর্থিক সহায়তাভাবে করেছে এমবেসি অব দ্যা নেদারল্যান্ডস্, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড কো-অপারেশন এবং অক্সফাম-নভিব, এবং সার্বিকভাবে প্রকাশনায় সাহায্য করেছে গণস্বাক্ষরতা অভিযান। বইটির লেখক অধ্যাপক গণেশ সরেন ও সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ সরেন (সান্তালী অংশ) প্রকৃতপক্ষেই শিশুদের জন্য সান্তালী জাতির সঠিক ইতিহাস, বীরত্ব, সংগ্রাম ও লোকগাঁথা তুলে ধরতে অক্ষম হয়েছেন। উপরন্তু বইটিতে রয়েছে প্রতি লাইনে বানান ও উচ্চারণে সমস্যা। যেহেতু, বইটির শুরুতেই ভুল আছে সেহেতু বইটির বাংলা অংশের সম্পাদকগণ ভাবানুবাদটুকু সঠিক দিতে পারেননি। ফলে সম্পূর্ণ বইটি বিভিন্ন ধরনের ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা। কোমলমতি সান্তাল শিশুরা বইটি পড়ে সহসাই বাংলা ও সান্তালী উচ্চারণের দ্বিধাদ্বন্দে ভূগবে। ফলে তারা কোনটাই ঠিকমত আয়ত্ব করতে পারবে না। স্কুল থেকেই ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাবে যেমটি হয়েছে ঐতিহাসিক বর্ষাপাড়ার স্কুলের অবস্থা।

যদিও সেই সময়ে তথাকথিত বাঙালি বুদ্ধিজীবিরা বাংলা হরফে সান্তালী ভাষা লেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করেছিলেন এবং এনজিও ও দাতা সংস্থা কর্তৃক বাংলা হরফে সান্তালী ভাষা প্রণয়নের সেই বিবেক বর্জিত কাজটি সমর্থন করেছিলেন তা সেই সময়ে ‘আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা: সাওঁতালী ভাষার অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে আ.ন.স হাবীবুর রহমান এর প্রবন্ধে প্রমাণিত। মি: রহমান তার প্রবন্ধে যে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন তা লক্ষ্যণীয়- “রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানার বর্ষাপাড়া গ্রামে বঙ্গলিপির মাধ্যমে সাওঁতালী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা সান্তালদের জন্য এক বিপ্লব বয়ে আনবে।” তিনি প্রবন্ধে আরো উল্লেখ করেন যে, “বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে একটিমাত্র অতিরিক্ত চিহ্ন ব্যবহার করা প্রয়োজন আর এটিও বাংলা  ‘ ে ৗ’  চিহ্নের শেষ অংশ ‘ৗ’ কাজেই সাঁওতালি ভাষা কম্প্যুটারে কম্পোজ ’করতেও সমস্যা হচ্ছে না। তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত বঙ্গলিপিতে সাঁওতালি ভাষা চর্চা করে শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শ্রেণী বাংলাভাষার সকল পাঠ্যপুস্তকে মনোনিবেশ করতে পারবে। তবে, শুরু থেকেই তাদের জন্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শেখানোর বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। বর্তমান গবেষণা কর্মসূচিতে প্রশিক্ষা ও ব্র্যাকের কিছু উপকরণ ব্যবহার করায় এই উদ্দেশ্য অনেকটাই সাধিত হচ্ছে।” যদিও গণস্বাক্ষরতা অভিযান এর নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, গণস্বাক্ষরতা অভিযান কর্তৃক প্রণিত “সাঁওতাল ঐতিহ্যগাথা” নামক বইয়ের “উপকরণ প্রসঙ্গ” এর চতুর্থ অনুচ্ছেদের উপকরণ প্রসঙ্গের শিরোনামে বলেছেন, ‘গণস্বাক্ষরতা অভিযান ইতোমধ্যে অনেক অব্যাহত শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন করলেও আদিবাসী বাংলা দ্বিভাষিক উপকরণ উন্নয়নের এটি প্রথম প্রয়াস। আমাদের আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও হয়তো এসব উপকরণে কিছু ভুলভ্রান্তি থেকেই যেতে পারে। এসব ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। এ বিষয়ে আগ্রহী ব্যাক্তি বা সংগঠনের মতামত সাদরে গৃহিত হবে।’ কিন্তু বইটি সর্ম্পকে জানতে চায়লে অধ্যাপক সরেন বিরুপ মনোভাব পোষণ করে বলেন, ‘আমার বাংলা ভাষায় সান্তালী বই লিখতে ইচ্ছে করেছিল বলে আমি লিখেছি, আপনার ইচ্ছে করলে আপনি আপনার মত করে বই লিখেন।’ দ্বিভাষিক পুস্তক প্রণেতা হিসেবে উনার প্রয়োজন জনমত যাচাই করা এবং ফলো-আপ নেয়া বইটি থেকে পাঠক উপকৃত হচ্ছে কিনা, উগ্রভাবে পাঠকের সাথে ব্যবহার করা নয়।

বইটি ইতোমধ্যে সান্তাল সমাজে সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং সামাজিক মিডিয়াতে বইটি বাতিলের দাবী উঠছে। সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন (সাসু) ‘সাওঁতাল ঐতিহ্যগাথা’ বইটি সর্ম্পকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলে, ‘ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার এবং লিপি সেই ভাষাকে সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে। কিন্তু কোন ভাষাকে যদি অবৈজ্ঞানিকভাবে ভুল লিপিতে উপস্থাপন করা হয়। সেক্ষেত্রে তা সর্ব সাধারণের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সান্তালী ভাষা হলো এমন ভাষা যা বাংলা হরফ দিয়ে লিখে কিছুটা উচ্চারণ করা গেলেও শুদ্ধভাবে উচ্চারণ কখনো সম্ভব না। ‘সাসু’ মনে করে বইটির লেখক অধ্যাপক গনেশ সরেন ও সম্পাদক যোগেন্দ্রনাথ সরেন বইটি প্রকাশনার পিছনে কাজ করে নিজেদেরকে কলঙ্কিতই করেছেন। ভাষা একটি স্পর্শকাতর বিষয়, আর এ ভাষা নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে ব্যাপকভাবে জনমত গ্রহণ করা দরকার। গণস্বাক্ষরতা অভিযান এর উচিত অবিলম্বে বইটি বাতিল করা নতুবা বইটি বাতিলের দাবীতে বাংলাদেশ সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে।
আদিবাসী সান্তালদের উপর শোষকগোষ্ঠী কর্তৃক জুলুম-অত্যাচারের কাহিনী নতুন নয়। দেশে সান্তাল আদিবাসীদেরকে বিভিন্ন কায়দায় জমি থেকে উচ্ছেদ, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। নওঁগায় চার সান্তাল খুন, আলফ্রেড সরেনের হত্যা, সেরাফিনা মার্ডীর বিচার এখনও চলমান।  সান্তাল আদিবাসীদেরকে কৌশলে জমি থেকে উচ্ছেদ করার জন্য সরকার এখনও সমতলে আদিবাসীদের জন্য কোন পৃথক ল্যান্ড কমিশন গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জন্য রয়েছে পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন। সমতল আদিবাসীদের উপর যে সহিংসতা বাড়ছে তা গত   ৯ আগস্ট ২০১১ দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত পার্থ শঙ্কও সাহা’র ‘আদিবাসীদের ওপর সহিংসতা বাড়ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রতিয়মান- “আদিবাসীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার কোনো আইনি প্রতিকার পাচ্ছেন না আদিবাসীরা। কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।” এ বছরের জুলাই পর্যন্ত তিনজন নারীসহ আটজন আদিবাসী খুন হয়েছে। ১০টি ধর্ষনের ঘটনাসহ ২৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত বছর খুন হয়েছিলেন ৩ জন নারীসহ ৭ আদিবাসী। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ২৮টি। আদিবাসীদের পরিচালিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশন সুত্রে এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। এ বছরে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে নওঁগায়। জেলার মান্দা উপজেলার চকগোপাল গ্রামে গত ৪ মে খুন হন চারজন আদিবাসী দিনমজুর।”

বাংলাদেশের বর্তমান আদমশুমারীতে সান্তালদের সঠিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়নি, উল্টো সান্তালদের দেখানো হয়েছে যে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। বাংলাদেশের আদমশুমারী ২০১১ এর মতে সান্তালদের সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ১১২, যা মোটেও সত্য নয়। গত ২৭ আগস্ট, ২০১১ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় শিশির মোড়ল তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- “৪৭ জেলায় আদিবাসীর সংখ্যা কমেছে !’ শীর্ষক প্রতিবেদন হতে প্রতিয়মান হয় যে,  বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদের সঠিক জনসংখ্যা সংরক্ষণে যত্নবান নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন- “উত্তরের জেলা নওঁগায় ২৪ হাজার ৪০৯ জন চাকমা বাস করে। আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নেতা অথবা এদের বিষয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যাক্তিরা বলেছেন, এটা ভুল তথ্য হাস্যকর। চাকমাদের বসবাসের স্থান পার্বত্য চট্টগ্রাম, নওঁগা নয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন প্রথম আলোকে বলেন,‘এই আদমশুমারির তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কোন অর্থ বহন করে না। ৪৭টি জেলায় কেন আদিবাসী মানুষ কমেছে এর ব্যাখ্যা পরিসংখ্যান ব্যুরোকে দিতে হবে। সংখ্যা কম দেখানো অর্থ রাষ্ট্র কর্তৃক আমাদের অধিকার অস্বীকার করা। আদিবাসীদের সংখ্যা যত কম দেখানো যাবে, সরকারের দায়িত্বও তত কম থাকবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ‘আদমশুমারি ও গৃহ গণনা ২০১১’ প্রকল্পের পরিচালক অসীম কুমার দে বলেন- ‘মাঠপর্যায়ের গণনাকারীরা যে তথ্য পেয়েছেন, আমরা সেই তথ্য প্রকাশ করেছি।’ সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে সাঁওতাল। এদের সংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ১১২ জন। সাঁওতালেরা প্রধানত উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বাস করে। রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, সারা দেশে সাঁওতালদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের হিসেবে সারা দেশে প্রায় পাঁচ লাখ সাঁওতাল বাস করে। ফিলিপ গাইনও বলেছেন, একাধিক জরিপ অনুযায়ী দেশে সাঁওতালদের সংখ্যা চার লাখ বা তারও বেশী।”


বিশ্বায়নের এ যুগে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর জোটসমূহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোকে তাদের আরেপিত  মতবাদের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে এডিবি, আইএমএফ এবং সর্বোপুরি বিশ্বব্যাংক এর মত আগ্রাসি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় শোষণ করে থাকে। এসব আগ্রাসি প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ঋণের জালে আবদ্ধ করে তাদের আরোপিত শর্তসমূহ অনুসারে পরিচালনা করছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ উন্নত বিশ্বের এসব তথাকথিত সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন শর্তানুযায়ী সর্বদাই জিম্মি। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমুহ তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ সব সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানের মতামতকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ফলশ্রতিতে সরকার সব বিদেশি প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে, জাতিসংঘ কর্তৃ ক পরিচালিত ইউএনডিপি কালচারাল প্রজেক্ট বাংলাদেশের আদিবাসীদের কৃষ্টি ও কালচারকে ‘কালচারাল প্রমোশনাল এক্টিভিটিস’ এর নামে বিরূপভাবে বিশ্ব দরবারে আদিবাসীদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করছে ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ এই শিরোনামের আওতায়। ফলে আদিবাসীরা নিজ সংস্কৃতি হতে ক্রমান্বয়ে বিচ্যূত হচ্ছে। বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মপন্থার মায়াজালে আদিবাসীদেরকে অর্ন্তভূক্ত করে তাদেরকে আরও কৌশলে  পিছিয়ে দিচ্ছে। সান্তাল জাতি এসব বিদেশি দাতাসংস্থার দ্বারা পরিচালিত দেশিয় এনজিও, তথাকথিত সুশিল সমাজের লেবাসধারী বুদ্ধিজীবী, সান্তাল না হওয়া সত্বেও সান্তালী ভাষার গবেষক হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ও কতিপয় সুবিধাবাদী আদিবাসী সংগঠনসমুহের কাছে জিম্মি। একবিংশ শতাব্দিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এখন সারাবিশ্বে প্রবাহমান। সচেতন সান্তাল সমাজ  এসব দেশিয় দোসর, উন্নয়নের নামে পরিচালিত এনজিও, বিদেশি দাতা সংস্থা সর্বোপরি সান্তালদের স্বার্থ বিরোধী সরকারের কোন সিদ্ধান্তকে মেনে নিবে না। কৌশলগত মারপ্যাচের জালে আবিষ্ট সান্তাল যুব সমাজ এখন বিদেশি প্রভুদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সরকারের যেকোন চাপিয়ে দেয়া সূক্ষ্ম মতবাদ (সবুজ সন্ত্রাস) কে ভবিষতে যেকোন মূল্যে প্রতিহত করবে ।

(লেখাটি সান্দেস ইস্যু 24, বছর 18, 2012 তে প্রকাশিত)

লেখক পরিচিতি: খোকন সুইটেন মূমূ
ঢাকা 
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি এনজিওতে কর্মরত এবং ফ্রিল্যান্সার লেখক ও গবেষক

শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৩

১:৩৮:০০ PM

বন্দি ফ্রেমে স্মৃতির হাতছানি ( পর্ব - 6)- সাসু’র অভিভাবক প্রয়োজন

 চরম উত্তেজনায় সময় কাটছিল ।  ঢাকায় একটি  সান্তাল ছাত্র সংগঠন হবে। যা সারা বাংলাদেশের সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে। দেবে সময়াচিত পরামর্শ। জীবনের ধাবন ক্ষেত্রে সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীরা পাবে অকুন্ঠিত সহযোগিতা। ঢাকায় যে সমস্ত সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীরা বাসস্থানের অভাবে, সঠিক নির্দেশনার অভাবে- দিক বেদিক ছুটাছুটি করছে, তারা পাবে সহযোগিতা। ধীরে ধীরে সাসুর এই মহতী কাজকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, বাংলাদেশের সর্বত্র। সান্তাল সমা,জ সাসু’র কাছ থেকে উপকৃত হবে।

সাসু’র নির্বাচিত প্রথম কমিটি
কোন কোন বিষয়গুলোতে সমাজকে তারা দিকনির্দেশনা দিবে এই বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরী হয়।
 প্রধান বিষয়গুলো নিম্ন রুপ:
ক) ছাত্র/ছাত্রীদের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহায়তা প্রদান করা।
খ) তাদের আবাসন ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা।
গ) গরীব মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের আর্থিক সহযোগিতার জন্য প্রচেষ্টা করা।
ঘ) সমাজের উপর কোন অন্যায় অত্যাচার হলে প্রতিবাদ করা এবং সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোসহ আরো বেশ কিছু প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা ছিল।

ঢাকায় ছাত্র সংগঠন করার প্রারম্ভিভ প্রস্তাবনা ছিল বর্তমান বাংলাদিশোম সান্তাল বাইসি’র শ্রদ্ধেয় চেয়ারপারশন মানতান এসসি আলবার্ট  সরেন-এর https://www.facebook.com/SCASOREN  । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্ত্বরে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটি মিটিং হয়। সেই মিটিং এ সংগঠন গঠন করার একটি প্রস্তাবনা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোন কমিটি তৈরী করা হয়নি।

তারপর ডেনিস মারান্ডী https://www.facebook.com/danis.marandy এবং লিটন সরেনসহ 5জন বিশিষ্ট একটি আহবায়ক কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ডেনিস মারান্ডীকে আহবায়ক কমিটির সভাপতি করে আবারো একটি নির্বাচন উত্তর শক্তিশালী আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।

পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে  একটি পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।  কমিটি গঠনের পর সংগঠনটির জন্য একটি সংবিধান তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সংবিধান তৈরীর জন্য আমার উপর ভার ন্যাস্ত করা হয়।  আমি ডেনিস দা, যোষেফ দাকে নিয়ে একটি সংবিধান দাড় করায়। যা সেই সময় সমাদৃত হয়। অতি অল্প সময়ে একটি পূর্ণা ঙ্গ সংবিধান তৈরী, সত্যিই আমাদের কাজের গতি এবং আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছিল।

1993 সাল থেকে  2013 প্রায় 20 বছর সাসুর পদচারণা। কিন্তু এই 20 বছরে অনেক চরাই উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে সাসুকে। শেষ প্রান্তে এসে সাসু যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। মাঝি বিহীন নৌকার মত আজ শুধু দুলছে। তাই এখন যা  খুবই প্রয়োজন----

সাসু’র অভিভাবকত্ব:
ক) অভিভাবকবিহীন একটি পরিবার আসলে টাল-মাটাল। সময়ের স্রোতে এখন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে প্রায় সবকিছু। তাই এখন সময় এসেছে সাসু’র মহৎ উদ্দেশ্য কে লালন করার। আর তা লালন করতে হলে প্রয়োজন, সাসুকে নির্জীব অবস্থা থেকে সজীব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

খ) বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের অভিভাবক সংগঠন রয়েছে। যার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলো কাজ করতে পারছে।

কারা সাসু’র অভিভাবক হতে পারে?
জাতীয় পর্যায়ের সান্তাল সংগঠন/সংগঠন গুলো।

উপদেষ্টা পরিষদ:
একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ প্রয়োজন।

কারা এই উপদেষ্টা পরিষদের থাকতে পারে?
সাসুর প্রাক্তন সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদক/ প্রাক্তন কমিটির বিভিন্ন সদস্যরা। সমাজের বিভিন্ন নেতা বা বর্তমানে পারগানা বাইসি।

উপদেষ্টা পরিষদ কি করবে?
বর্তমান সাসু’র  কেন্দ্রিয় কমিটিকে বিভিন্ন পরামর্শ এবং দিক নিদের্শনা প্রদান করবে।

অভিভাবক সংগঠন কি করবে?
1) উপদেষ্টাদের মাধ্যমে  তারা সাসুকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
2) জাতীয় কোন ইস্যুতে তারা একটি দায়িত্ব নিয়ে বা পরিকল্পনা করে সাসুর মাধ্যমে তা সম্পাদন করতে পারে। যেহেতু ছাত্র অবস্থায় একজন ছাত্রের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িত হওয়া প্রায় তার জ্ঞান ভান্ডারকে প্রসারিত করে, তাই এই রকম বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ত হওয়া সেই ছাত্ররই জ্ঞানের পরিধিকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
3) সাসু’র বিভিন্ন কার্যবলি দেখভাল করা।
4) সাসুকে গ্রাম পর্যায়ে প্রসারিত করার  ক্ষেত্রে তারা উদ্যোগী ভুমিকা পালন করতে পারে।
5) বাংলাদেশে সান্তালদের সংগঠন পরিচালনা করার বড় একটি সমস্যা হচ্ছে, ডোনার সমস্যা বা আর্থিক সমস্যা,  এই সমস্যায় তারা একটি ভাল ভুমিকা পালন করতে পারে।

সময় এসেছে আমাদের ভাবার। সময় এসেছে আমাদেরকে আরো সুসংগঠিত করার। তাই আমাদের মধ্যে যে ক্ষুদ্র স্বার্থ  গুলো রয়েছে, সেই গুলোকে পরিত্যাগ করে আমাদের এগিয়ে আসা দরকার। অত্যন্ত আমাদের সবার জন্য, আমাদের সমাজের জন্য ।

আজ বাংলাদেশের সান্তালরা বড়ই নিগৃত। নেই তাদের কোন অধিকার। যেখানে সেখানে সান্তালরা হচ্ছে হয়রানির শিকার, হামলা-মামলায় তারা জর্জরিত। এ মুর্হুতে তাদের আরো সুসংগঠিত হওয়ার অতীব প্রয়োজন এবং এটা সময়ের দাবী ।

আমরা নিশ্চয় অনুভব করছি। তাই সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। সময় ক্ষেপন নয়, বরং এখনি।

ফিরে দেখা:
সাসু’র  নির্বাচিত কমিটি- যে কমিটির সময় সাসু ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাসুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, শহর থেকে গ্রাম পর্য ন্ত। বড় বড় দুটি জাতীয় সম্মেলন করে এই কমিটি সাফল্য দেখিয়েছিল।

সভাপতি:

ইফ্রাইম সরেন
বর্তমান বায়োগ্রাফি:  গ্রাজুয়ট এবং আইটি বিশেষজ্ঞ ।
বর্তমানে একটি আবাসন সুসজ্জিত করণ কোম্পানীতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।
https://www.facebook.com/efraim.soren?fref=ts




সাধারন সম্পাদক:
ডেনিস মারান্ডী
বর্তমান বায়োগ্রাফি:  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সাফল্যের সাথে অর্নাস মাস্টার্স সম্পন্ন করা, অত্যন্ত মেধাবী। বর্তমানে একটি এনজিওতে আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
https://www.facebook.com/danis.marandy




সহসভাপতি:

আমোষ মুর্মু
বর্তমান বায়োগ্রাফি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স মাষ্টার্স
 সম্পন্ন করা। বর্তমানে একটি এনজিও তে চাকুরী করছেন।
https://www.facebook.com/amosh.murmu.7?fref=ts










সহসাধারন সম্পাদক: 
প্রণয় রিচার্ড বেশরা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়ন অবস্থায় ব্যবসায় নিয়োজিত হন। একজন ব্যবসায়িক।







সাংগাঠনিক সম্পাদক:
মুক্ত গ্রেগরী বেশরা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করা। বর্তমানে একটি এনজিওতে চাকুরীরত।








সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক এবং প্রথম সান্দেস পত্রিকার সম্পাদক
সুনীল ডগলাস হেমরম
বর্তমান বায়োগ্রাফি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান এ অনার্স মাস্টার্স করা। বর্তমানে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকুরীরত।








কার্যকরী সদস্য:
ফিলিপ মূর্মূ
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি এনজিও’র পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

https://www.facebook.com/philip.murmu.7?fref=ts







কার্যকরী সদস্য:
যোষেফ হাঁসদা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করা। বর্তমানে ইতালীতে অবস্থান করছেন। https://www.facebook.com/photo.php?fbid=418572764312&set=a.456630434312.222894.647984312&type= 1&theater








কার্যকরী সদস্য:
মার্শেল হাসঁদা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।








ক্যাশিয়ার:
নেলশন সরেন
বর্তমান বায়োগ্রাফি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিং এ অর্নাস মাস্টার্স করা। বর্তমানে একটি এনজিওতে কর্মরত।
https://www.facebook.com/photo.php fbid=274924649264844&set= a.274922365931739.63258.100002419343552&type=1&theater





মহিলা বিষয়ক সম্পাদক
মুন্নি হেমরম




১:৩৮:০০ PM

বন্দি ফ্রেমে স্মৃতির হাতছানি ( পর্ব - 6)- সাসু’র অভিভাবক প্রয়োজন

 চরম উত্তেজনায় সময় কাটছিল ।  ঢাকায় একটি  সান্তাল ছাত্র সংগঠন হবে। যা সারা বাংলাদেশের সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে। দেবে সময়াচিত পরামর্শ। জীবনের ধাবন ক্ষেত্রে সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীরা পাবে অকুন্ঠিত সহযোগিতা। ঢাকায় যে সমস্ত সান্তাল ছাত্র/ছাত্রীরা বাসস্থানের অভাবে, সঠিক নির্দেশনার অভাবে- দিক বেদিক ছুটাছুটি করছে, তারা পাবে সহযোগিতা। ধীরে ধীরে সাসুর এই মহতী কাজকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে, বাংলাদেশের সর্বত্র। সান্তাল সমা,জ সাসু’র কাছ থেকে উপকৃত হবে।

সাস’র নির্বাচিত প্রথম কমিটি
কোন কোন বিষয়গুলোতে সমাজকে তারা দিকনির্দেশনা দিবে এই বিষয়ে একটি খসড়া নীতিমালাও তৈরী হয়।
 প্রধান বিষয়গুলো নিম্ন রুপ:
ক) ছাত্র/ছাত্রীদের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহায়তা প্রদান করা।
খ) তাদের আবাসন ব্যবস্থার দিকে নজর রাখা।
গ) গরীব মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের আর্থিক সহযোগিতার জন্য প্রচেষ্টা করা।
ঘ) সমাজের উপর কোন অন্যায় অত্যাচার হলে প্রতিবাদ করা এবং সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোসহ আরো বেশ কিছু প্রারম্ভিক প্রস্তাবনা ছিল।

ঢাকায় ছাত্র সংগঠন করার প্রারম্ভিভ প্রস্তাবনা ছিল বর্তমান বাংলাদিশোম সান্তাল বাইসি’র শ্রদ্ধেয় চেয়ারপারশন মানতান এসসি আলবার্ট  সরেন-এর https://www.facebook.com/SCASOREN  । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্ত্বরে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে একটি মিটিং হয়। সেই মিটিং এ সংগঠন গঠন করার একটি প্রস্তাবনা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোন কমিটি তৈরী করা হয়নি।

তারপর ডেনিস মারান্ডী https://www.facebook.com/danis.marandy এবং লিটন সরেনসহ 5জন বিশিষ্ট একটি আহবায়ক কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ডেনিস মারান্ডীকে আহবায়ক কমিটির সভাপতি করে আবারো একটি নির্বাচন উত্তর শক্তিশালী আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।

পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে  একটি পূর্নাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়।  কমিটি গঠনের পর সংগঠনটির জন্য একটি সংবিধান তৈরীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সংবিধান তৈরীর জন্য আমার উপর ভার ন্যাস্ত করা হয়।  আমি ডেনিস দা, যোষেফ দাকে নিয়ে একটি সংবিধান দাড় করায়। যা সেই সময় সমাদৃত হয়। অতি অল্প সময়ে একটি পূর্ণা ঙ্গ সংবিধান তৈরী, সত্যিই আমাদের কাজের গতি এবং আন্তরিকতা প্রকাশ পেয়েছিল।

1993 সাল থেকে  2013 প্রায় 20 বছর সাসুর পদচারণা। কিন্তু এই 20 বছরে অনেক চরাই উতরাই অতিক্রম করতে হয়েছে সাসুকে। শেষ প্রান্তে এসে সাসু যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। মাঝি বিহীন নৌকার মত আজ শুধু দুলছে। তাই এখন যা  খুবই প্রয়োজন----

সাসু’র অভিভাবকত্ব:
ক) অভিভাবকবিহীন একটি পরিবার আসলে টাল-মাটাল। সময়ের স্রোতে এখন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে প্রায় সবকিছু। তাই এখন সময় এসেছে সাসু’র মহৎ উদ্দেশ্য কে লালন করার। আর তা লালন করতে হলে প্রয়োজন, সাসুকে নির্জীব অবস্থা থেকে সজীব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা।

খ) বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ছাত্র সংগঠনের অভিভাবক সংগঠন রয়েছে। যার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলো কাজ করতে পারছে।

কারা সাসু’র অভিভাবক হতে পারে?
জাতীয় পর্যায়ের সান্তাল সংগঠন/সংগঠন গুলো।

উপদেষ্টা পরিষদ:
একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা পরিষদ প্রয়োজন।

কারা এই উপদেষ্টা পরিষদের থাকতে পারে?
সাসুর প্রাক্তন সভাপতি/ সাধারণ সম্পাদক/ প্রাক্তন কমিটির বিভিন্ন সদস্যরা। সমাজের বিভিন্ন নেতা বা বর্তমানে পারগানা বাইসি।

উপদেষ্টা পরিষদ কি করবে?
বর্তমান সাসু’র  কেন্দ্রিয় কমিটিকে বিভিন্ন পরামর্শ এবং দিক নিদের্শনা প্রদান করবে।

অভিভাবক সংগঠন কি করবে?
1) উপদেষ্টাদের মাধ্যমে  তারা সাসুকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতে পারে।
2) জাতীয় কোন ইস্যুতে তারা একটি দায়িত্ব নিয়ে বা পরিকল্পনা করে সাসুর মাধ্যমে তা সম্পাদন করতে পারে। যেহেতু ছাত্র অবস্থায় একজন ছাত্রের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িত হওয়া প্রায় তার জ্ঞান ভান্ডারকে প্রসারিত করে, তাই এই রকম বিষয়গুলোতে সম্পৃক্ত হওয়া সেই ছাত্ররই জ্ঞানের পরিধিকে আরো বাড়িয়ে দেবে।
3) সাসু’র বিভিন্ন কার্যবলি দেখভাল করা।
4) সাসুকে গ্রাম পর্যায়ে প্রসারিত করার  ক্ষেত্রে তারা উদ্যোগী ভুমিকা পালন করতে পারে।
5) বাংলাদেশে সান্তালদের সংগঠন পরিচালনা করার বড় একটি সমস্যা হচ্ছে, ডোনার সমস্যা বা আর্থিক সমস্যা,  এই সমস্যায় তারা একটি ভাল ভুমিকা পালন করতে পারে।

সময় এসেছে আমাদের ভাবার। সময় এসেছে আমাদেরকে আরো সুসংগঠিত করার। তাই আমাদের মধ্যে যে ক্ষুদ্র স্বার্থ  গুলো রয়েছে, সেই গুলোকে পরিত্যাগ করে আমাদের এগিয়ে আসা দরকার। অত্যন্ত আমাদের সবার জন্য, আমাদের সমাজের জন্য ।

আজ বাংলাদেশের সান্তালরা বড়ই নিগৃত। নেই তাদের কোন অধিকার। যেখানে সেখানে সান্তালরা হচ্ছে হয়রানির শিকার, হামলা-মামলায় তারা জর্জরিত। এ মুর্হুতে তাদের আরো সুসংগঠিত হওয়ার অতীব প্রয়োজন এবং এটা সময়ের দাবী ।

আমরা নিশ্চয় অনুভব করছি। তাই সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার। সময় ক্ষেপন নয়, বরং এখনি।

ফিরে দেখা:
সাসু’র  নির্বাচিত কমিটি- যে কমিটির সময় সাসু ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাসুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, শহর থেকে গ্রাম পর্য ন্ত। বড় বড় দুটি জাতীয় সম্মেলন করে এই কমিটি সাফল্য দেখিয়েছিল।

সভাপতি:

ইফ্রাইম সরেন
বর্তমান বায়োগ্রাফি:  গ্রাজুয়ট এবং আইটি বিশেষজ্ঞ ।
বর্তমানে একটি আবাসন সুসজ্জিত করণ কোম্পানীতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।
https://www.facebook.com/efraim.soren?fref=ts




সাধারন সম্পাদক:
ডেনিস মারান্ডী
বর্তমান বায়োগ্রাফি:  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সাফল্যের সাথে অর্নাস মাস্টার্স সম্পন্ন করা, অত্যন্ত মেধাবী। বর্তমানে একটি এনজিওতে আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।
https://www.facebook.com/danis.marandy




সহসভাপতি:

আমোষ মুর্মু
বর্তমান বায়োগ্রাফি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স মাষ্টার্স
 সম্পন্ন করা। বর্তমানে একটি এনজিও তে চাকুরী করছেন।
https://www.facebook.com/amosh.murmu.7?fref=ts










সহসাধারন সম্পাদক: 
প্রণয় রিচার্ড বেশরা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়ন অবস্থায় ব্যবসায় নিয়োজিত হন। একজন ব্যবসায়িক।







সাংগাঠনিক সম্পাদক:
মুক্ত গ্রেগরী বেশরা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করা। বর্তমানে একটি এনজিওতে চাকুরীরত।








সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক এবং প্রথম সান্দেস পত্রিকার সম্পাদক
সুনীল ডগলাস হেমরম
বর্তমান বায়োগ্রাফি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান এ অনার্স মাস্টার্স করা। বর্তমানে একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকুরীরত।








কার্যকরী সদস্য:
ফিলিপ মূর্মূ
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করে বর্তমানে একটি এনজিও’র পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

https://www.facebook.com/philip.murmu.7?fref=ts







কার্যকরী সদস্য:
যোষেফ হাঁসদা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: গ্রাজুয়েট সম্পন্ন করা। বর্তমানে ইতালীতে অবস্থান করছেন। https://www.facebook.com/photo.php?fbid=418572764312&set=a.456630434312.222894.647984312&type= 1&theater








কার্যকরী সদস্য:
মার্শেল হাসঁদা
বর্তমান বায়োগ্রাফি: আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।








ক্যাশিয়ার:
নেলশন সরেন
বর্তমান বায়োগ্রাফি: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাউন্টিং এ অর্নাস মাস্টার্স করা। বর্তমানে একটি এনজিওতে কর্মরত।
https://www.facebook.com/photo.php fbid=274924649264844&set= a.274922365931739.63258.100002419343552&type=1&theater





মহিলা বিষয়ক সম্পাদক
মুন্নি হেমরম




মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৩

৩:০২:০০ PM

দিনাজপুর এবং দখল

ছবি: দিনাজপুর গ্রুপ থেকে গৃহিত
দিনাজপুর আমার যে কোন স্বপ্ন থেকেও বেশী কিছু প্রচন্ড খরতাপেও দিনাজপুরের মাটিতে পা রাখলেই মনে হয়, ‘কে যেন শীতল হাতের ছোঁয়ায়, আমায় প্রশান্তি দিলবার বার কোনো প্রেয়সির কাছে যদি ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়, তাহলে সেই প্রেয়সি - দিনাজপুর বার বার যদি কখনও জন্ম নিতে হয়, তাহলে বলবো- দিনাজপুরেই যেন হয়

যদিও খুব ছোট বেলায় দিনাজপুর ছেড়ে, ঢাকায় আসতে হয়েছে, তবুও দিনাজপুরের জন্য এতটুকুও ভালবাসা কমেনি কমেনি হাতছানি দেওয়ার মত ভালবাসার টান বরং যতই দুরে আছি, ততই যেন টানটা বেশী অনুভব করি যেন এক বিনা সংযোগের আত্মিক বন্ধন বন্ধন ছিঁড়ার নয় বাঁধন খুলে ফেলবারও নয়

যদিও আমার জন্মস্থান দিনাজপুর শহর থেকে নব্বইটি কিলোমিটার দুরে শহরতলির আলো আধারের স্বপ্নিল মোহময় চাকচিক্য থেকে দুরে- একটি ছোট্ট থানা শহরে তবুও দিনাজপুর শহর যেন আমার স্বপ্নের শহর কৈশরের স্মৃতি মনে পড়লেই, আজো অজানা এক ভাললাগা আমার সর্বাঙ্গে দোল দিয়ে যায় পুলকিত করে তোলে তনুমন আমি হারিয়ে যাই, আমার কৈশরের প্রারম্ভে

একটি স্মৃতিচারণ না করলে, দিনাজপুর নিয়ে আমার অনুভূতির পেয়ালা থেকে গড়িয়ে পড়া আমৃতসার কিছুটা অপূর্ণই থেকে যাবে

বাবা প্রানী সম্পদে চাকুরি করতেন আর চাকুরির সুবাদে প্রায় দিনাজপুর জেলা শহরে যাওয়া হতো আমি তখন ক্লাশ টু-তে পড়ি বাবার সাথে দিনাজপুরে গিয়েছি আমার আবার সিনেমা দেখার খুব শখ শখ বললে ভুল হবে, বলতে হবে সিনেমাটা আসলে কি? সেটা দেখার জন্যই বেশী উৎসুকতা বাবার সাথে হোটেলে উঠেছি, সারাদিন বাবার সাথে তার অফিসের কাজে সাথে সাথে আছি, কিন্তু মনের ভিতর ঘুনপোকাটা সব সময় যেন ভিতরটা কাটছে, - সেটা টের পাচ্ছি দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে, বাবার কাজ শেষ হয় না দেখে, ভীষণ খারাপ লাগে সন্ধ্যা নামে, দিনাজপুর শহর মায়াবী সাজে, সাজে রিক্সায় বাবার সাথে বসে আছি, রাস্তায় লাইট গুলো আলোকিত করে আমাকে, আর আমার স্বত্ত্বাটাকে ভরে দেয় কানায় কানায় ভালালাগা টুকু রিক্সা কোন প্রান্ত থেকে কোন প্রান্তে ছুটছিল সেটা বুঝিনি বুঝিনি কোন অলিগলির মধ্যে দিয়ে আমার ভাললাগার পরশটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছিল শুধু বুঝেছিলাম অন্য রকম ভাললাগা আমার উপর ভর করেছে

কিন্তু ছো্ট্ট একটি অপূর্ণতা বার বার পিছনে হেচকা টেনে আটকে দিচ্ছিল এক হোটেলে খাওয়া দাওয়ার পর, আবার রিক্সায় উঠেছি আমি এবার কিছুটা বিরক্ত আমরা কেন এতো রিক্সায় ঘুরাঘুরি করছি বাবাকে বিরক্তের সুরে জিজ্ঞেস করি বাবা বলে , ঘুরতে খারাপ লাগছে আমি বলি, না বাবা আমাকে রাতের সুন্দরী, রাতের দিনাজপুরকে দেখাচ্ছিলেন রাতের দিনাজপুর যে এত সুন্দর, এত মায়াবী আজ স্মৃতির সাগরে ডুব দিলে বুঝতে পারি এখনো সেই ভালালাগা দক্ষিণা হাওয়ার মতো দোল দিয়ে যায় সিনেমা হলের আসে পাশে যাওয়া হয়নি কখনো তাই সেখানে কি হয়, তাও আমার জানা নেই এবার সাহস করে বাবাকে বলি, বাবা সিনেমা দেখবো বাবা আমার দিকে তাকায়, সাথে সাথে রিক্সাওয়ালাকে বলে, লিলি মোড়ে যাও আমি বুঝিনা, লিলি মোড়ে কেন লিলি মোড়ে আসতেই অনেক লাইটের আলোয় বিরাট পোস্টার চোখে পড়ে পোস্টার টা পড়ার চেষ্টা করছিলাম তিনটা অক্ষর বানান করতে খুব কষ্ট হয়নি কিন্তু উচ্চারণ করতে একটু সময় লেগেছিল --, হ্যাঁ সিনেমাটির নাম ছিল দখল আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবা টিকেট কেটেছে আমরা সিনেমা হলে ঢুকলাম বিরাট পর্দায় বড় বড় মানুষ, অবাক হয়ে দেখছি ভাল লাগছে সেই বয়সেই বুঝতে পারছি, সিনেমায় কোন কিছু নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, অন্যায় ভাবে কোন কিছু কেউ কেড়ে নিচ্ছে তাই ঘটনার তালগোলে আমিও হারিয়ে যায় শুধু স্মৃতির আকাশে এখনো মাঝে মাঝে বেজে উঠেভালবাসা এমন একটি গান, কথা আর সুরে বাধা, যেন দুটি প্রানআজো ভুলিনি অবিশাস্য 

দিনাজপুর থেকে আজ অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে ভালবাসার বন্ধনকে কেউ ছিঁড়ে ফেলার মত, ছিঁড়তে চাইছে সিনেমার দখলদারদের কথা গুলো মনে নাই, কিন্তু আজো এক শ্রেনীর দখলদারদের হাতে আমরা বন্দি বন্দি আমাদের বিবেক বন্দি আমার ভালবাসা-ভালালাগা প্রকাশ করার ইচ্ছে টুকু আমাদের ভালবাসা-ভাললাগা আমরা লালন করতে চাই, একান্ত আমাদের মত একান্ত নিজের মতো করে কোনো দখলদার যেন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে কামনায় ভাল থেকো দিনাজপুর ভাল রেখো আমাদেরকে

About

Ghonokuasha Baskey is a Santal writer of Bangladesh. He has started writing since 1985.