বৃহস্পতিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৫

সান্তালদের সহরায় উৎসব- বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা

সহরায় উৎসব:
সান্তালদের  সবচেয়ে বড় উৎসব সহরায় পরব বা পর্ব। সান্তালরা ফসল কাটার পর এই উৎসব পালন

করে থাকে। এই উৎসব পালনের যৌক্তিকতা ভাল ফসল পাওয়ার জন্য তাদের পশু, তাদেরকে সাহায্য করেছে- এই জন্য মারাংবুরুর কাছে এই উৎসবের মাধ্যমে উৎসর্গকরণের উদ্দেশ্যে এই উৎসবটি পালন করা হয়ে থাকে।
এই উৎসব সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সান্তালরা পালন করে থাকে।

প্রথম দিন:
এই উৎসব তিন দিনব্যাপী পালন করা হয় আবার কোন কোন জায়গায় পাঁচ দিনও পালন করা হয়ে থাকে। প্রথম দিনের উৎসবের নাম মুলত: Ũmuḱ পরিস্কৃত

হওয়া। প্রথম দিনে সান্তালরা তাদের পূর্বপুরুষ এবং মারাংবুরুর উদ্দেশ্যে উপাসনা দিয়ে শুরু করে। এই উপাসনা বা  পুজা আর্চনা যেখানে প্রচুর গাছ রয়েছে সেখানে সম্পন্ন হয় অথবা  জাহের থান নামে সান্তালদের উপাসনাস্থলে এটি হয়ে থাকে। জাহেরথান সাধারণত যেখানে গাছপালা বেশী থাকে সেখানে বানানো হয়। আগের দিনে লতাপাতার ছাউনির মত করে এই পুজা মন্ডপ বানানো হত। সেই পুজার স্থানে সবাই একসঙ্গে সমবেত হয়। পুজার আগে  সবার বাড়ি থেকে চাল এবং মুরগী সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই মুরগী এবং চালের কিছু অংশ মারাংবুরু এবং পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে মাঞ্জি হাড়ামের নেতৃত্বে বলি দেওয়া হয়। এখানে মুরগী মাথা মটকিয়ে রক্তগুলো সামনে পাতায় রাখা অল্প চালগুলোর মধ্যে ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

পুজা সমাপ্ত হলে সেই মুরগী মাংশ এবং চাল দিয়ে পোলাও খিচুরি রান্না করা হয়। রান্না সমাপ্ত হলে প্রথমে সেই রান্নার একটি অংশ গ্রামের মাঞ্জি হাড়ামকে দেওয়া হয়। সেই রাতে খাওয়া দাওয়া সম্পন্ন হলে পরের দিনের অনুষ্ঠানের জন্য তারা প্রস্তুত হয়।

দ্বিতীয় দিন: 

দ্বিতীয় দিন পুরোটাই পশুদের উদ্দেশ্যে উৎযাপন করা হয়, পশুদের গোসল করানো হয় । এই দিনের
শুরুতে সবাই রান্না করা ভাত এবং একটি করে ডিম নেন। পশুরা যে রাস্তার চলাচল করে সেই রাস্তায় সেগুলো রেখে দেওয়া হয়, যাতে পশুদের আঘাতে ডিম গুলো ভেঙ্গে যায়। এই দিনে পশুদের গোসল করিয়ে পশুদের শরীরে, শিং এ তেল মাখানো হয় এবং পা ধুয়ে দেওয়া হয়। এটা এমন ধরনের উৎসব যাতে পশুদের প্রতি সম্মান দেখানো হয়। এই সব কিছু শেষ হলে সবাই ঘরের দিকে যায়। 
মাঠ থেকে ধানের গাছ নিয়ে আসেন এবং এটা পুজায় এটা ব্যবহৃত হয়। পুজার পর তারা সেই ধানগাছের গোছা পশুদের শিং এ বেঁধে দেয়। সহরায় উৎসবে পূর্ব পুরুষ এবং মারাংবুরুর নামে হান্ডি উৎসর্গ করে থাকে। তারা এই  পুজার মাধ্যমে আর্শিবাদ ও সুখী জীবন কামনা করে থাকে।  এই রাত থেকে পশুদেরকে লোকেরা জাগায় এবং বাড়ী বাড়ী গিয়ে নাচ-গান করে থাকে। তৃতীয় দিন পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকে।


তৃতীয় দিন:
উৎসবের তৃতীয় দিনকে বলা হয় Khunṭạo গবাদী পশুদের এক জায়গায় বেঁধে রাখা
এবং একজন
Khunṭạo

ব্যক্তি শুকনো কোন চামড়া সেই পশুটির নাকের সামনে ধরে। এতে পশুটি খিপ্ত হয়ে সেই শুকনো চামড়াটিকে শিং দিয়ে আঘাত করেন। এ রকম বিষয়টি পর পর তিন বার করা হয় এবং প্রতিবারেই ভিন্ন ভিন্ন গান গেয়ে পর্বটি পালন করা হয়ে থাকে। এভাবে প্রতিটি পশুকে তারা বাধার মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘটে।

বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতা:
সংস্কৃতি সবসময় চলমান একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটা মুলত সভ্যতার সাথে সাথে চলতে শুরু করেছে। বিকশমান সংস্কৃতির ধারায় যেমন অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে আবার অনেক কিছুই কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। প্রায় সব সংস্কৃতির বিরাট অংশ জুড়ে ধর্ম জাড়িয়ে থাকার দরুন এটা ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তনের সাথে সাথে এর প্রকার, এর আচার, এর পরিপালনও পরিবর্তিত হয়েছে। আবার অর্থনৈতিক অবস্থার দরুনও সংস্কৃতির অনেক বিষয়গুলো পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান সান্তালদের আর্থসামাজিক অবস্থা:
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশের সান্তালদের বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখানে শুধু সান্তালদের বললে একটু ভুল বলা হবে। বলা যায় পুরো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা কিছুটা বদলে গিয়েছে। বাঙালী সংস্কৃতির জায়গাটাতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন যুক্ত হয়েছে। সান্তালরাও এর বাইরে যেতে পারেনি। আর যাওয়ারও কোন কারণ নেই। কেননা স্রোতের বিপরীতে চলে, টিকে থাকা অনেক কঠিন।

নব্বই দশকে সান্তালদের মধ্যে আমুল কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। এই পরিবর্তনের মুল জায়গাগুলো- অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাস। অর্থনৈতিকভাবে তারা প্রায় হঠাৎ করে গরীর পর্যায়ে চলে যায়। আর সাথে সাথে সান্তালদের বিরাট অংশ ধর্মীয় বিশ্বাস পরিবর্তন করে। একটি বেসরকারী হিসেব অনুযায়ী বর্তমানে সান্তালরা 95% ভাগই গরীব এবং প্রায় 85% ভাগ ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেছে। এমতাবস্থায় তাদের সংস্কৃতি কি পরিমান বেসামাল হতে পারে, তা একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায়।


বাংলাদেশের সান্তালদের সহরায় উৎসব:
সান্তালদের বিরাট অংশ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করার ফলে সান্তালদের সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের সান্তালরা তাদের সংস্কৃতির অনেক কিছু করে চলছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সহরায় পরব, এটার মুল উদ্দেশ্য যা থেকে অনেক সান্তালরা সরে আসেননি। যদিও খ্রিস্টান ধর্মে এ রকম উৎসব পালন করার কোন বিধান নেই, তবুও বাংলাদেশের সান্তালরা তাদের সংস্কৃতির বড় একটি উৎসব সহরায় পরব পালন করছে। বড়দিন আর সহরায়কে একাক্কিভুত করে বর্তমান বাংলাদেশের আধুনিক সান্তালরা সহরায় পর্ব পালন করছে। বড়দিনকে সামনে রেখে তারা এই নতুন সহরায় উৎসবটিকে সাজিয়ে থাকে। সহরায়ের দিনপঞ্জি অনুযায়ে যদিও এটি সংগঠিত হয় না। তবুও ঐ দিন গুলোতে এ রকম ব্যবস্থা কোন কোন গ্রামে দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে বাইবেলের ইতিহাসের দিকে তাকালেও এর মিল পাওয়া যায়। বাইবেলের প্রাচীন ইস্রায়েল জাতির মধ্যে এই উৎসবটি পালন করার প্রচলন ছিল। ভাল ফসল হওয়ার জন্য ইস্রায়েল জাতি, তাদের ঈশ্বর-যিহোবার কাছে প্রথম ফসল উঠার পর উৎসর্গ করত।  ফসল কাটার মরসুমগুলোতে তাদের উৎসবের দিনপঞ্জি ছিল। যিশু খ্রিস্টের মুক্তির মুল্যের বিনিময়ে মোশির ব্যবস্থা হতে আক্ষরিক নিস্তার পাওয়ার পর খ্রিস্টানরা এ রকম উৎসব করে না। 


সান্তালদের প্রাচীন সহরায় পর্বে তাদের আর্শিবাদ এবং সুখী জীবনের জন্য মারাংবুরু এবং তাদের আদি পুরুষদের আত্মার নিকট প্রার্থনা করে সাহায্য চাওয়াটা একটা মুখ্য বিষয় ছিল। বিষয়টি শুধু উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিষয়টি বিশ্বাস এবং উপাসনার পর্যায়ে নিমজ্জিত। বর্তমান ধর্মান্তরিত সান্তালরা যখন এ রকম অনুষ্ঠান করেন, তখন বিষয়টি দাড়ায়, দুই কর্তার দাসত্বের মত।

একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের সান্তালদের গলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু ছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ সান্তালদের গলা ভরা ধান নেই, পুকুর ভরা মাছ নেই, গোয়াল ভরা ধানও নেই। তাহলে কিভাবে এই উৎসব পালন করবে? যে উৎসবটির মুলে রয়েছে, ফসলের জন্য প্রার্থনা, গবাদি পশুর প্রতি সম্মান জানানো। আজ যাদের কিছুই নেই, তারা কিভাবে উৎসবটি করবে?

প্রারম্ভে যেমন বলেছিলাম, সংস্কৃতি সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। যে কারণগুলোর জন্য সংস্কৃতির এই আচার আচরণ সেই কারণ গুলো যদি না থাকে, তাহলে কি সেটা পালন করা কতটা যুক্তিযুক্ত? পরিবর্তনশীল এই সংস্কৃতির জায়গায় সান্তালরা কি তাদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে? এ রকম প্রশ্নের অবতারণা হতে পারে। এ প্রশ্নের উত্তরে শুধু সান্তালদের দিকে অঙ্গুলি তুললে কিছুটা অন্যায় করা হবে বৈকি। আজ সারা পৃথিবীতে জাতিগুলোর সামনে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং পরিপালন করা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।

কি করা যেতে পারে?

1। সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মের সাথে যে বিষয়গুলো সরাসরি যুক্ত, সেই বিষয়গুলো নিয়ে সমাজে আলোচনা হতে পারে। ধর্মীয় বিশ্বাসকে সরাসরি আঘাত করে না বা ব্যহত করে না এমন বিষয়গুলো সান্তালরা পালন করতে পারে। আবার ধর্মীয় অংশটুকু বাদ দিয়েও সেই বিষয়গুলো তারা করতে পারে।
2। সংস্কৃতির বিরাট একটা অংশ জুড়ে কৃষ্টি ও কালচার রয়েছে। যা সরাসরি ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। সেই বিষয়গুলো অনুশীলন করে, বর্তমান সান্তাল সমাজ তাদের পরিচয় বহন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাষার সঠিক চর্চার মাধ্যমে একটা জাতির পরিচয় অক্ষুন্ন থাকতে পারে।
3। সংস্কৃতির মধ্যে সমাজ কাঠামোগুলো অন্তর্ভুক্ত। সমাজ কাঠামোকে যদি আর গতিশীল এবং সত্যিকার নিয়ামক করা যায়, তাহলে সান্তাল হিসেবে নিজের পরিচয় টুকু ধরে রাখা সম্ভব।
4। উৎসবহীন জাতি নিরামিষ জাতি। উৎসব বিহীন একটি জাতি কল্পনা করাটাও কঠিন। তাই জীবনে উৎসবগুলো থাকা উচিত। কিন্তু সেই উৎসব গুলোর মধ্যে অবশ্যই উন্নয়ন বা উন্নতির ধারাবাহিকতা থাকা উচিত। অর্থাৎ উৎসবের মধ্যেও যাতে নিজেদের উন্নতি থাকে সেদিকে মনোযোগ দিলে জাতি হিসেবে সান্তালরা আরও এগিয়ে যেতে পারবে।


সময়ের সাথে সারা বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে। সান্তালরা পিছিয়ে থাকবে এমনটা হতে পারে না। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক আদিবাসি আজ তাদের সংস্কৃতিকে ঢেলে সাজাচ্ছে। তারা সেটা করেও বিশ্বের কাছে আদিবাসি হিসেবে পরিচিত, সমদৃত। আমরা তাহলে কেন পারবো না? নিশ্চয় পারবো, শুধু আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, ঠুনকো আবেগ গুলো থেকে। বেরিয়ে আসতে হবে, ধর্মীয় রেষারেষি থেকে।



কোন মন্তব্য নেই:

About

Ghonokuasha Baskey is a Santal writer of Bangladesh. He has started writing since 1985.