174 টি ভোট = জামানত বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশের সান্তাল সমাজ (পর্ব -2)
সবেমাত্র স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে। বহুদলীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার জন্য দেশ প্রস্তুত। হ্যাঁ 1991সালের কথা বলছি। সেই স্কুল জীবন থেকে মার্কস, লেলিনদের মধুময় মন্ত্রে কিছুটা বিভোর ছিলাম। আর খুব অল্প বয়সে ছাত্র ইউনিয়নের পতাকা তলে দাড়িয়ে বর্জুয়াদের বিপক্ষে কড়া কড়া স্লোগান শিখে ফেলেছিলাম। সেই গরমের জ্বরে হয়ত, সব সময় রাজনীতি নামক পোকাটা আমাকে চিবাতো। সেই চিবুনির জ্বরে হোক আর রক্ত গরমের ঝালে হোক এলাকায় রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করাটা দৌদিপ্যমান ছিল।
মনে প্রানে যেখানে বামের স্বপ্ন লালন করি, সেখানে তো চুপ করে থাকা বড়ই বেমানান। ঠিকই একদিন আমার স্কুলের ইমতিয়াজ (গনিত পড়াতেন) স্যারের হাতে ধরা পড়ি। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি বিকেলে আমার সাথে দেখা কর”। বিকেলে স্যারের কাছে গেলাম, স্যার তার বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেলেন, সেখানে অনেক মুরুবী বসা। আমি সাইজ এবং বয়সে সব চেয়ে ছোট। পরিচয় করে দিলেন, সবার সাথে , তার মধ্যে তন্ময় দেব এবং আলতাফুজ্জামান মিতা ভাই ছিলেন, তাদের নাম আমার মনে আছে। তন্ময় দা বললেন, বাম করে তুমি কি পাবে? কিছুই পাবে না। এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, সবার জন্য, তোমরা আদিবাসি আমরা হিন্দু, আমাদের এ দেশে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সময় এখনই। বামে গেলে, সারা জীবন রাস্তায় থাকতে হবে, নতুবা বাটপারি করে খেতে হবে।
কিছুক্ষণ পর মিতা ভাই আমাকে কাছে ডেকে বললেন, এই থানাতে আমাদের কোন ছাত্র সংগঠন নেই। তুমি এর প্রতিনিধিত্ব করবে। আমি তো হ। আগামী সপ্তাহে জননেত্রী গোবিন্দগঞ্জে সভা করবেন, তুমি সংখ্যালগু সম্প্রদায় থেকে জননেত্রীর আগে বক্তৃতা দিবে এবং এই থানার ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করবে। তার দুদিন পর আমাকে যুগ্ন আহবায়ক করে থানা ছাত্রলীগের প্রথম প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি গঠন করা হয়। জননেত্রীর সভা থেকে ফিরে আসার পর। অনেক ভাবনা আর চিন্তায় নিজেকে বিলিন করে দেই। দেশ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এবং আমার অধিকার।
ইতিমধ্যেই নির্বাচনের তফশীল ঘোষনা হয়ে যায়। সুভাষ মন্ডল সরেন আমাকে ডাকেন এবং বলেন, ”বাবু আমাকে তো নির্বাচন করার কথা বলা হচ্ছে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন দল থেকে?” উত্তর দিলেন, ওয়াকার্স পার্টি থেকে, তুমি আমার ক্যাম্পেইন করে দেও।” আমি বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু কে আপনাকে চিনলো আর কেনই বা আপনাকে দাড় করাচ্ছে?” তিনি জবাব দিলেন, “দিনাজপুর থেকে আমাকে জানানো হয়েছে?” “কিন্তু আমি তো জানি বুদলা উরাওকে বাম মোর্চা থেকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।” আমি বললাম। তিনি জবাব দিলেন, “ না আমাকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।” আমি তো থ, এটা কিভাবে সম্ভব? যে লোক কোনদিনই রাজনীতির মাঠে ছিল না, তাকে এমপি পদে মননোয়ন দিয়ে দিল? হতে পারে কারন ওয়াকার্স পার্টি তো তখনও আমার কাছে পরিচিত ছিল না।
অন্য একটি সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে আসীন আমি, তারপরও কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায়, তার উপায় খুজতে লাগলাম। কারণ, একজন সান্তাল এমপি মননোয়ন পেয়েছে। আর এ আসনে এত সান্তালদের ভোট। তাকে আমি ভিতর ভিতর সাহায্য করি। ঠিক ভাবনার সাথে কাজ শুরু ।
সন্ধ্যা নামলেই চিকা মারার জন্য বেরিয়ে পড়তাম। কখনো কখনো রাতে আর ফেরা হয়নি। ছাত্রলীগের নেতার কল্যানে সারাদিন এর ওর বাইকে ঘোড়াঘাট থেকে বিরামপুর দিনে রাতে কতবার যে চুসে ফেলে ছিলাম, তা মনে নেই।
ভোটের দিন যতই কাছে আসতে লাগল, ততই বুঝলাম। আদিবাসিরা এ দেশের রাজনীতির যোগ্য নয়। সুভাষ মন্ডল সরেন দেদারসে জমি বিক্রি করে ক্যাম্পেইন করতে লাগল। লাছু পারগানা এলাকার বংশ পরম পরায় জমিদার। তার ছেলে সুভাষ মন্ডল সরেন জমি বিক্রি করে রাজনীতি করছে, এটা আমার ভাল লাগেনি। আমি অনুধাবন করতে পারি, কেন ওয়াকার্স পার্টি তাকে নমিনেশন দিয়েছে? কেন বুদলা উরাঁওকে নমিনেশন দেওয়া হয়নি। আমার কাছে এটা আলোর মত পরিস্কার হয়ে গেল।
ভোটের রেজাল্ট হলো। সুভাষ মন্ডল সরেনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ইতিমধ্যে কলেজে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি ছাত্র সংসদে জিএস পদের জন্য নমিনেশন পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু প্রথম বর্ষের ছাত্র হওয়ার কারণে আমাকে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে দেওয়া হলো না। আমাকে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে বলা হলো, এজিএস পদের নমিনেশন কিনলাম। কেনার পরই, আমার খুব কাছের বন্ধু রবিউল ইসলাম, আমার বাড়ীতে এলেন। একজন সান্তাল ছেলের বাড়ীতে একজন মুসলমান বন্ধুর আগমন। মাটির দেওয়াল আর জংধরা টিনের চালের নিচে তার আকুতি আমাকে নরম করে তুলল। সে আমাকে বলল, দোস্ত তুই পদটা আমাকে দে। তুই সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ইলেকশন কর।
ইলেকশন করলাম। তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল আমার। তাই কোন ক্যাম্পেইন করতে হলো না। ভোটের রেজাল্ট হলো, আমি ছাড়া আমার প্যানেলের সবাই 200 ভোটেরও বেশী ব্যবধানে ছাত্রদলের প্যানেলের কাছে হেরে যায়।
আমি আবার পেছন ফিরে থাকাই। আমার মিছিলের সেই দিনগুলোতে প্রতিদিনই প্রায় 10-15 জন সান্তাল ছাত্ররা যোগ দিত। আমার আশ্চর্য লাগে, সেই দিন সান্তাল ছাত্রীরাও আমার মিছিলে সামিল হতো। সান্তালদের রক্তে প্রতিবাদ ছিল এবং আছে। কিন্তু আজ কোথায় হারিয়ে গেল।
সুভাষ মন্ডল সরেনকে রাজনীতি নি:স্ব করেছে। বুদলা উরাঁও রাজনীতি আর সমাজনীতি করতে করতে হারিয়ে গেল। নিকোলাস নামই কোন একজন তারও জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। সান্তালরা তাহলে কি রাজনীতির কাছে অসহায়?
ঢাকায় এলাম। সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন (সাসু), বাংলাদেশ গঠনে মনোযোগ দিলাম। 1993 সালে সাসু গঠিত হলো, সারা বাংলাদেশে সান্তালদের মধ্যে একটা প্রানচঞ্চল শুরু হয়ে গেল। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও সাসু যেন সান্তালদের আশার স্বপ্ন দেখাল।
এরিই মধ্যে হঠাৎ করে রাজপথে ছোট্ট ছোট্ট ঝান্ডা নিয়ে অনিল মারান্ডিরা সামনে এলো। ঢাকায় এলে আমাদের আশ্রয় প্রশয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করলো। সে সময় সাসু দ্বারা পরিচালিত ঢাকার পারগানা হাউজ তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। জাতীয় আদিবাসি পরিষদ বলা যায়, সাসু’র হাত ধরেই শিখতে লাগল। শহীদ মিনারের পাদদেশ, অডিটোরিয়াম কিংবা টিএসসি চত্বর, সাসুই তাদের চিনিয়েছিল।
সেই দিন বুঝতে পারিনি, তারা রাজপথে স্বপ্ন বিক্রি করার সূচনা করেছিল। যেখানে সাসু মানুষের কল্যান করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা গুলো চালিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে আদিবাসি পরিষদ,“আদিবাসি” নামক শব্দটিকে মুলধন করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় এটাকে জীবিকার মাধ্যমে হিসেবে মনে হয়নি। তবে অনিল মারান্ডীর সময়গুলোতে এখনকার জাতীয় আদিবাসি পরিষদ-এর মত পুরোপুরি রাজপথে আদিবাসি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠেনি। আর ফলশ্রুতিতে আমার জানামতে 2003 সাল পর্যন্ত সাসু এবং আদিবাসি পরিষদের সম্পর্ক চমৎকার ছিল।
জাতীয় আদিবাসি পরিষদ, আদিবাসি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠার পেছনে রবীন্দ্রনাথ সরেনের পুরো হাত আছে। কেননা তার ব্যক্তি জীবনকে একটু যদি পর্যালোচনা করেন, তাহলে লক্ষ্য করবেন। কোন চাকুরী বা কাজ ছাড়াই একদিন দিনাজপুর থেকে রাজশাহীতে পাড়ি দিয়েছিলেন লালসালু’র মজিদের মত। সেখানে বামের সালু পরে পুরোটাই এখন লাল হয়ে গিয়েছেন।
একটা সময় আসে, যখন জীবিকা এবং ব্যবসা সংগঠনকে অন্ধ করে দেয়। জাতীয় আদিবাসি পরিষদ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জয়পুরহাটের, নগাঁও এবং রাজশাহীর ঘটনাগুলো জাতীয় আদিবাসি পরিষদকে সান্তালদের কাছ দুরে সরিয়ে দেয়।
জাতীয় আদিবাসি পরিষদ আরও একটি নতুন খেলায় মেতে উঠে। এ খেলাটাও প্রমান করে যে, তারা ব্যবসায়িক। ধর্মের বিশ্বাসকে পুজি করে সান্তাল এবং আদিবাসিদের বিভক্ত করতে থাকে। প্রায় সরাসরিই ঘোষণা দেয় যে, খ্রিস্টান সান্তালরা আর আদিবাসি নয়।
নতুন প্রজম্ন এই বিভক্তিকে ভাল চোখে দেখেনি। তাদের স্বার্থপরতাগুলোকে এই প্রজম্ন বুঝতে পেরে তাদেরকে দুরে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সাসু’র প্রতিষ্ঠাকালিন সংবিধান অনুযায়ি, সাসু কখনো কারও ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত করে না। সান্তালদের 12টি পদবির অধিকারী হলেই সে এ সংগঠনে যুক্ত হতে পারে।
সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের বর্তমান নেতৃত্ব দূঢ়তার সাথে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে যে, আমরা বিভক্তি সান্তাল সমাজ চাই না। আমরা একটি একতাবন্ধ সান্তাল সমাজ চাই। ধর্ম, চার্চ এর উর্ধে থেকে সাসু’র বর্তমান সদস্যরা সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সেই আমি আমার রাজনীতির জামানতও অনেক আগেই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নি:স্ব সুভাষ মন্ডল সরেন, না ফেরার দেশে গিয়েও নি:স্ব বুদলা উরাঁও। আর শুধু জেগে আছে রাজপথের স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা।
মনে প্রানে যেখানে বামের স্বপ্ন লালন করি, সেখানে তো চুপ করে থাকা বড়ই বেমানান। ঠিকই একদিন আমার স্কুলের ইমতিয়াজ (গনিত পড়াতেন) স্যারের হাতে ধরা পড়ি। স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তুমি বিকেলে আমার সাথে দেখা কর”। বিকেলে স্যারের কাছে গেলাম, স্যার তার বাইকের পেছনে বসিয়ে নিয়ে গেলেন, সেখানে অনেক মুরুবী বসা। আমি সাইজ এবং বয়সে সব চেয়ে ছোট। পরিচয় করে দিলেন, সবার সাথে , তার মধ্যে তন্ময় দেব এবং আলতাফুজ্জামান মিতা ভাই ছিলেন, তাদের নাম আমার মনে আছে। তন্ময় দা বললেন, বাম করে তুমি কি পাবে? কিছুই পাবে না। এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, সবার জন্য, তোমরা আদিবাসি আমরা হিন্দু, আমাদের এ দেশে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সময় এখনই। বামে গেলে, সারা জীবন রাস্তায় থাকতে হবে, নতুবা বাটপারি করে খেতে হবে।
কিছুক্ষণ পর মিতা ভাই আমাকে কাছে ডেকে বললেন, এই থানাতে আমাদের কোন ছাত্র সংগঠন নেই। তুমি এর প্রতিনিধিত্ব করবে। আমি তো হ। আগামী সপ্তাহে জননেত্রী গোবিন্দগঞ্জে সভা করবেন, তুমি সংখ্যালগু সম্প্রদায় থেকে জননেত্রীর আগে বক্তৃতা দিবে এবং এই থানার ছাত্রলীগের প্রতিনিধিত্ব করবে। তার দুদিন পর আমাকে যুগ্ন আহবায়ক করে থানা ছাত্রলীগের প্রথম প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটি গঠন করা হয়। জননেত্রীর সভা থেকে ফিরে আসার পর। অনেক ভাবনা আর চিন্তায় নিজেকে বিলিন করে দেই। দেশ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এবং আমার অধিকার।
ইতিমধ্যেই নির্বাচনের তফশীল ঘোষনা হয়ে যায়। সুভাষ মন্ডল সরেন আমাকে ডাকেন এবং বলেন, ”বাবু আমাকে তো নির্বাচন করার কথা বলা হচ্ছে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোন দল থেকে?” উত্তর দিলেন, ওয়াকার্স পার্টি থেকে, তুমি আমার ক্যাম্পেইন করে দেও।” আমি বললাম, “ঠিক আছে। কিন্তু কে আপনাকে চিনলো আর কেনই বা আপনাকে দাড় করাচ্ছে?” তিনি জবাব দিলেন, “দিনাজপুর থেকে আমাকে জানানো হয়েছে?” “কিন্তু আমি তো জানি বুদলা উরাওকে বাম মোর্চা থেকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।” আমি বললাম। তিনি জবাব দিলেন, “ না আমাকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে।” আমি তো থ, এটা কিভাবে সম্ভব? যে লোক কোনদিনই রাজনীতির মাঠে ছিল না, তাকে এমপি পদে মননোয়ন দিয়ে দিল? হতে পারে কারন ওয়াকার্স পার্টি তো তখনও আমার কাছে পরিচিত ছিল না।
অন্য একটি সংগঠনের দায়িত্বশীল পদে আসীন আমি, তারপরও কিভাবে তাকে সাহায্য করা যায়, তার উপায় খুজতে লাগলাম। কারণ, একজন সান্তাল এমপি মননোয়ন পেয়েছে। আর এ আসনে এত সান্তালদের ভোট। তাকে আমি ভিতর ভিতর সাহায্য করি। ঠিক ভাবনার সাথে কাজ শুরু ।
সন্ধ্যা নামলেই চিকা মারার জন্য বেরিয়ে পড়তাম। কখনো কখনো রাতে আর ফেরা হয়নি। ছাত্রলীগের নেতার কল্যানে সারাদিন এর ওর বাইকে ঘোড়াঘাট থেকে বিরামপুর দিনে রাতে কতবার যে চুসে ফেলে ছিলাম, তা মনে নেই।
ভোটের দিন যতই কাছে আসতে লাগল, ততই বুঝলাম। আদিবাসিরা এ দেশের রাজনীতির যোগ্য নয়। সুভাষ মন্ডল সরেন দেদারসে জমি বিক্রি করে ক্যাম্পেইন করতে লাগল। লাছু পারগানা এলাকার বংশ পরম পরায় জমিদার। তার ছেলে সুভাষ মন্ডল সরেন জমি বিক্রি করে রাজনীতি করছে, এটা আমার ভাল লাগেনি। আমি অনুধাবন করতে পারি, কেন ওয়াকার্স পার্টি তাকে নমিনেশন দিয়েছে? কেন বুদলা উরাঁওকে নমিনেশন দেওয়া হয়নি। আমার কাছে এটা আলোর মত পরিস্কার হয়ে গেল।
ভোটের রেজাল্ট হলো। সুভাষ মন্ডল সরেনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ইতিমধ্যে কলেজে প্রথম ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি ছাত্র সংসদে জিএস পদের জন্য নমিনেশন পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু প্রথম বর্ষের ছাত্র হওয়ার কারণে আমাকে জিএস পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে দেওয়া হলো না। আমাকে এজিএস পদে প্রতিদ্বন্দিতা করতে বলা হলো, এজিএস পদের নমিনেশন কিনলাম। কেনার পরই, আমার খুব কাছের বন্ধু রবিউল ইসলাম, আমার বাড়ীতে এলেন। একজন সান্তাল ছেলের বাড়ীতে একজন মুসলমান বন্ধুর আগমন। মাটির দেওয়াল আর জংধরা টিনের চালের নিচে তার আকুতি আমাকে নরম করে তুলল। সে আমাকে বলল, দোস্ত তুই পদটা আমাকে দে। তুই সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ইলেকশন কর।
ইলেকশন করলাম। তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল আমার। তাই কোন ক্যাম্পেইন করতে হলো না। ভোটের রেজাল্ট হলো, আমি ছাড়া আমার প্যানেলের সবাই 200 ভোটেরও বেশী ব্যবধানে ছাত্রদলের প্যানেলের কাছে হেরে যায়।
আমি আবার পেছন ফিরে থাকাই। আমার মিছিলের সেই দিনগুলোতে প্রতিদিনই প্রায় 10-15 জন সান্তাল ছাত্ররা যোগ দিত। আমার আশ্চর্য লাগে, সেই দিন সান্তাল ছাত্রীরাও আমার মিছিলে সামিল হতো। সান্তালদের রক্তে প্রতিবাদ ছিল এবং আছে। কিন্তু আজ কোথায় হারিয়ে গেল।
সুভাষ মন্ডল সরেনকে রাজনীতি নি:স্ব করেছে। বুদলা উরাঁও রাজনীতি আর সমাজনীতি করতে করতে হারিয়ে গেল। নিকোলাস নামই কোন একজন তারও জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। সান্তালরা তাহলে কি রাজনীতির কাছে অসহায়?
ঢাকায় এলাম। সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন (সাসু), বাংলাদেশ গঠনে মনোযোগ দিলাম। 1993 সালে সাসু গঠিত হলো, সারা বাংলাদেশে সান্তালদের মধ্যে একটা প্রানচঞ্চল শুরু হয়ে গেল। ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও সাসু যেন সান্তালদের আশার স্বপ্ন দেখাল।
এরিই মধ্যে হঠাৎ করে রাজপথে ছোট্ট ছোট্ট ঝান্ডা নিয়ে অনিল মারান্ডিরা সামনে এলো। ঢাকায় এলে আমাদের আশ্রয় প্রশয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করলো। সে সময় সাসু দ্বারা পরিচালিত ঢাকার পারগানা হাউজ তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। জাতীয় আদিবাসি পরিষদ বলা যায়, সাসু’র হাত ধরেই শিখতে লাগল। শহীদ মিনারের পাদদেশ, অডিটোরিয়াম কিংবা টিএসসি চত্বর, সাসুই তাদের চিনিয়েছিল।
সেই দিন বুঝতে পারিনি, তারা রাজপথে স্বপ্ন বিক্রি করার সূচনা করেছিল। যেখানে সাসু মানুষের কল্যান করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা গুলো চালিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে আদিবাসি পরিষদ,“আদিবাসি” নামক শব্দটিকে মুলধন করে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে সময় এটাকে জীবিকার মাধ্যমে হিসেবে মনে হয়নি। তবে অনিল মারান্ডীর সময়গুলোতে এখনকার জাতীয় আদিবাসি পরিষদ-এর মত পুরোপুরি রাজপথে আদিবাসি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠেনি। আর ফলশ্রুতিতে আমার জানামতে 2003 সাল পর্যন্ত সাসু এবং আদিবাসি পরিষদের সম্পর্ক চমৎকার ছিল।
জাতীয় আদিবাসি পরিষদ, আদিবাসি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে উঠার পেছনে রবীন্দ্রনাথ সরেনের পুরো হাত আছে। কেননা তার ব্যক্তি জীবনকে একটু যদি পর্যালোচনা করেন, তাহলে লক্ষ্য করবেন। কোন চাকুরী বা কাজ ছাড়াই একদিন দিনাজপুর থেকে রাজশাহীতে পাড়ি দিয়েছিলেন লালসালু’র মজিদের মত। সেখানে বামের সালু পরে পুরোটাই এখন লাল হয়ে গিয়েছেন।
একটা সময় আসে, যখন জীবিকা এবং ব্যবসা সংগঠনকে অন্ধ করে দেয়। জাতীয় আদিবাসি পরিষদ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জয়পুরহাটের, নগাঁও এবং রাজশাহীর ঘটনাগুলো জাতীয় আদিবাসি পরিষদকে সান্তালদের কাছ দুরে সরিয়ে দেয়।
জাতীয় আদিবাসি পরিষদ আরও একটি নতুন খেলায় মেতে উঠে। এ খেলাটাও প্রমান করে যে, তারা ব্যবসায়িক। ধর্মের বিশ্বাসকে পুজি করে সান্তাল এবং আদিবাসিদের বিভক্ত করতে থাকে। প্রায় সরাসরিই ঘোষণা দেয় যে, খ্রিস্টান সান্তালরা আর আদিবাসি নয়।
নতুন প্রজম্ন এই বিভক্তিকে ভাল চোখে দেখেনি। তাদের স্বার্থপরতাগুলোকে এই প্রজম্ন বুঝতে পেরে তাদেরকে দুরে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু সাসু’র প্রতিষ্ঠাকালিন সংবিধান অনুযায়ি, সাসু কখনো কারও ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত করে না। সান্তালদের 12টি পদবির অধিকারী হলেই সে এ সংগঠনে যুক্ত হতে পারে।
সান্তাল স্টুডেন্টস্ ইউনিয়নের বর্তমান নেতৃত্ব দূঢ়তার সাথে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে যে, আমরা বিভক্তি সান্তাল সমাজ চাই না। আমরা একটি একতাবন্ধ সান্তাল সমাজ চাই। ধর্ম, চার্চ এর উর্ধে থেকে সাসু’র বর্তমান সদস্যরা সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
সেই আমি আমার রাজনীতির জামানতও অনেক আগেই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। নি:স্ব সুভাষ মন্ডল সরেন, না ফেরার দেশে গিয়েও নি:স্ব বুদলা উরাঁও। আর শুধু জেগে আছে রাজপথের স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন