সান্তালরা চার্চগুলোর নগ্ন একনায়কতন্ত্রের শিকার
প্রেক্ষাপট: আদি
আমি একটু পেছনের দিকে
ফিরে যেতে চাই । ঠিক যখন বাংলাদেশে সান্তালদের মধ্যে বিভিন্ন চার্চের মিশনারীরা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার শুরু করেছিল, ঠিক সময়টাতে। এখানে অবশ্য আর একটি কথা বলে রাখা ভাল, তাহলো- সতের শতাব্দির দিকে যখন ইংরেজ সহ অন্যান্য বণিকরা ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আসে, তখন সম্ভবত এই অঞ্চলে প্রথম সান্তালদের কাছেই ধর্ম প্রচার করা হয়েছিল। কারণটা তাদের অনন্তজীবনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। কারণ ছিল স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কেন এমন কথা বলছি।
কারণ ভারতের মেদিনীপুর হয়ে যখন বণিকরা উপরের দিকে বাণিজ্যের জন্য যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, তখণ সর্বপ্রথম সান্তালদের মাধ্যমে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। ফলে তাদের ধারনা হয়েছিল যে, যদি তাদেরকে খ্রিষ্টান বানানো যায়, তাহলে তারা তাদের লোক হয়ে যাবে এবং তারা অবাদে বাণিজ্য করতে পারবে। পরবর্তীতে তারা তাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে খ্রিষ্টান বানানো চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে তারা কামিয়াভ হয়নি। কারণ ধনসম্পদ ঐশ্বর্য্যে সান্তালরা অনেক ভাল অবস্থায় ছিল। তাই কোন প্রলোভন তাদেরকে কাবু করতে পারেনি।
এই পরের ইতিহাসটা একটু ভিন্ন এবং দৃশ্যপটও আলাদা। বাংলাদেশের সান্তালদের যে এলাকায় প্রথম মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই অঞ্চলের সান্তালদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা যদি বিবেচনা করে দেখি, তাহলে দেখবো সেখানকার সান্তালরা কিছুটা বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে ততটা স্বাবলম্বী ছিল না। এই পরিস্থিতিগুলো বিবেচনা করে দেখা যায় যে, সান্তালদেরকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধার লোভ দেখিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হযেছিল। এই বিষয়টা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে বিশেষ দু’একটি এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অনুমান করা হয়।
তাহলে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক সান্তাল খ্রিষ্টানদের বেলায় কি বলা যায়? সবাই কি তাহলে অর্থনৈতিক কারণগুলোর জন্য খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করেছে? না। তবে তাদেরকে এমন কিছু পরিস্থিতিতেও খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করতে
বাধ্য করা হয়েছে, যা অনৈতিক।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধরুন আপনার একটি সন্তান রয়েছে, আপনি তাকে ভাল একটি স্কুলে ভর্তি
করাতে চান। সন্তানকে হোস্টেলে রাখতে হবে। এসবের জন্য আপনি যোগাযোগ করছেন, ফাদার কিংবা
চার্চের পাস্টরের কাছে। তিনি আপনাকে নির্লজ্জ ভাবে জানিয়ে দিলেন। এই স্কুলের হোস্টেলে
শুধু তাদের চার্চের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে রাখা হয়, অন্যদের রাখা হয় না। আপনার সামনে সামনে
দুটো পথ খোলা আছে। একটি আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে সেই চার্চের সদস্য হতে
হবে। নতুবা আপনার নিকট আত্মীয়-স্বজন যদি চার্চের থাকে, তাহলে আপনি আপনার সন্তানকে সেই
স্কুলের বা বোডিং এ ভর্তি করাতে পারবেন। এই রকম বিষয়গুলোতে জড়িয়েও অনেককে বাধ্য হয়েছে,
খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহন করতে। তবে এই ঘটনাগুলো খ্রিষ্টান হওয়ার পেছনে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে
ধরা যেতে পারে।
একটি বিরাট সংখ্যক সান্তালরা
কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে। তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো
এত গুরুত্ব আকারে দেখা দেয়নি, যখন ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এখানেও বিরাট একটি বিষয়
ঘটে গিয়েছে, হয়ত অজান্তে কিংবা জেনে শুনে। আর বিষয়টি হলো- যে সান্তালরা খ্রিষ্ট ধর্ম
গ্রহণ করেছে, তারা অনেকেই খ্রিষ্ট ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস গুলোর সাথে ভালভাবে পরিচিত
নয়। আর একটু সহজ করে বললে বলা যায়, তারা বাইবেলের শিক্ষার সাথে শিক্ষিত নয়। ফলে তারা
পরমপরাগত ভাবে ধর্মটাকে পালন করে আসছে কিন্তু এর যে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, সেই বিষয়টাকে
ভালভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে একতরফা ভাবে সান্তালদের দোষ দেওয়াটাও সমিচিন
হবে না । কারণ জগতের যে খ্রিষ্ট ধর্ম বা চার্চগুলো রয়েছে, তারা নিজেরাই বাইবেলের শিক্ষা
থেকে অনেক দুরে সরে গিয়েছে। ফলে সান্তালরা এর একটা শিকার মাত্র।
বাংলাদেশে সান্তালদের
কাছে যখন মিশনারীরা ধর্ম প্রচার করেছে, তখণ একটি পরিস্থিতি ছিল। এখন এই পরিস্থিতি বা
প্রেক্ষাপট দ্রুত বদলে যেতে থাকে। মিশনারীরা চলে যেতে থাকে। চার্চগুলোর পরিচালনায় দায়িত্বগুলোতে
বাঙালী খ্রিষ্টানরা চলে আসে। আর স্বভাবগতভাবেই বা জেনেটিকালি বাঙালীদের শরীরের মধ্যে
কর্তৃত্ব পরায়নের মত জিনগুলো বংশ পরমপরায় বহন করে আসছে। কেন এই কথাটি বললাম?
সান্তাল বিদ্রোহের ইতিহাসের
পেছনের দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আগে সান্তালরা
এদেশের বাঙালী বা দিকুদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছিল। আর এই যুদ্ধগুলো ছিল, জোর করে তাদের
সম্পদ কেড়ে নেওয়া, জমি দখল করা, জোর করে কাজ করানো, এই রকম বিভিন্ন কারণগুলো। আর সেই
জন্য এখনো সান্তালদের সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালী বা দিকুরা ভিলেন হিসেবে-গানে, কবিতায়
আর বিভিন্ন গল্পগাঁথার মধ্যে স্থান করে রেখেছে।
প্রেক্ষাপট:
বর্তমান
দীর্ঘ শতক অপেক্ষার পর
বাংলাদেশের সান্তালদের মধ্যে থেকৈ দু একটি চার্চে প্রধান হিসেবে সান্তালরা নিয়োগ পেয়েছেন,
কিন্তু অভিযোগ আছে। যে লোকেরা দৃঢ়চেতা নয় কিংবা বাঙালীদের আজ্ঞাবহ ঠিক সেই রকম লোকদেরই
প্রধান জায়গাগুলোতে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। নতুবা যদি দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হন, তাহলে তার
সাথে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া হয়, যাতে তারা সেই ব্যক্তিতে কনভেন্সড করতে পারেন।
কিংবা সেই ব্যক্তি সান্তালদের পক্ষে কোন নিরঙ্কুশ কাজ না করতে পারেন। তৈরী করা হয়,
পদে পদে বাধা।
বাবা-মা চার্চে চাকুরি করলে --চাকুরি হারাবে।
চার্চের কোন কিছুর সাথে জড়িত থাকলে--সেটা আর থাকবে না।
আপনি যদি চার্চের কোন স্কুলের বা হোস্টেলের ছাত্র হোন-তাহলে সেখানে আপনার নাম থাকবে না।
চার্চে একটি মেকি কমিটি বা আজ্ঞাবহ কমিটি তৈরী করা হয়। যেখানে বিশপ বা রেভারেন্ড –এর তলপিবাহক
লোকেরাই স্থান পান। যারা মেরুদন্ডসোজা করতে পারবেন না। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অন্যায় অবিচারের
বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে পারবেন না। ঠিক এই রকম লোকদেরই তাদের কমিটিতে প্রয়োজন।
কারণ চার্চ তো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যা করেন, সেটাই সঠিক
এবং মেনে নিতে হবে।
খুব তাড়াতাড়ি চার্চের নগ্ন আচরণ
বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দীর্ঘদিন সান্তালদের আটকে রাখা হয়েছে, ষড়যন্ত্রের জালে। এই জাল
এখন ছিন্ন করার সময়। আমরা দিকু এবং সম বিশ্বাসীদের নব্য আধিপত্যবাদিদের কাছে আর বন্দি
হয়ে থাকতে চাই না। আমাদের বেরিয়ে আসার সময় এখনই। আমরা যদি এখন বেরিয়ে আসতে না পারি,
তাহলে আমরা এমন একটি সময়ে অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে যাব, সেখানে রাস্তা খুজে পাব না। পথ
আমাদের জন্য আর কঠিন হয়ে পড়বে। রাজশাহীর হোস্টেল
বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিনের সান্তালদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের একটি অংশমাত্র।
সান্তালরা যখন পড়াশুনার দিকে আশাতীত ভাবে উন্নতি করছে, ছিঠ তখনি তাদের সাহায্যকারী
সামান্য সুযোগগুলো তারা বন্ধ করে দিচ্ছে। অভিদিও এর মত মেধাবীদের আমরা হারাচ্ছি, ঠিক
এই সময়গুলোতে আমাদের উপর এই নগ্ন হস্তক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নগ্ন হস্তক্ষেপগুলো: যেমন রাজশাহী শহরের বিভিন্ন চার্চের অনেক হোস্টেল ছিল কিন্তু এখন হাতেগোনা কয়েকটি।
সময় এখন আমাদের, বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের মুক্ত
চিন্তার জগতে। আর নয় ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন