মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বন্দি ফ্রেমে স্মৃতির হাতছানি ( পর্ব - 2)


সাসুর প্রথম নির্বাচন, জর্জদা সভাপতি, ডেনিসদা সাধারন সম্পাদক, লরেন্স সাংগাঠনিক সম্পাদক, নেলশন ক্যাশিয়ার, দিপ্তী সম্ভবত মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, আমোষদা সহসভাপতি, ফিলিপদা, ইফা মামা, মুক্তদা, মার্শেল মামা, ইলিয়াস কাকু, প্রণয়, মুন্নি, নির্বাচিত কমিটিতে ছিল। আর আমি প্রায়ই নিজের কাধে সংস্কৃতি সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম। শুরু হলো আর একটি স্বপ্নের রুপায়ন। শুরু হলো বাংলাদেশে প্রথম বিরাট পরিসরে একটি বাংলা ভাষায় পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। “সান্দেস” নামটি চুড়ান্ত করা হলো। পত্রিকার নামের সাথে যাদের নাম স্মরণীয় ভাবে জড়িয়ে থাকা উচিত, তাদের মধ্যে একজন ইলিয়াস মারান্ডী। সেই মার্শেল মামার মতোই খুব অবেলায় আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তার চলে যাওয়াটা বড় অনাদরে, অবহেলায়, আজকের সমাজ সেবকরা সেদিন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে, হয়ত আজকেও আমরা তাকে পেতাম, আমাদের চিন্তার বালিরেখা গুলোকে শানিত করার মাধ্যম হিসেবে। সান্দেসে তার লেখা, প্রথম সাড়া জাগানো প্রবন্ধ “সান্তালদের বিছিন্নতার অন্তরালে ধর্মই দায়ী”। হয়ত এই লেখাটিই তাকে স্বার্থপর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, বিচ্ছিন্ন করেছিল অর্থনৈতিক সাহায়্যের হাত থেকে। সে যখন স্ট্রক করলো, আমি জানতে পেরে গিয়েছিলাম, আমাদের আত্নীয়তার সুত্রে আমি তাকে কাকা ডাকতাম। কাকু আমার দিকে ফেল ফেল করে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করেছিল “ভাসতা কেমন আছ”? হুইল চেয়ারে বসে একজন লড়াকুর এমন জিজ্ঞাসা, আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল। আমি নিজেকে স্বংবরণ করে, জিজ্ঞেস করেছিলাম “চাচা চেৎ লেকা মেনাক মেয়া?” কাকু প্রশ্ন শেষ করার সাথে ছোট্ট বাচ্চার মতো হু হু করে কেদেঁ উঠে, ডান পাশ্বের অবশ হাতটা প্রচন্ড শক্তি দিয়ে উঠানোর চেষ্ঠা করে, আমার দিকে অনেক অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “ইন দং চেকায়েনা, ইন দং চেকায়েনা।” এবার কান্নাটা আরো তীব্র হয়ে উঠল। আমি আমার চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার নিজের অজান্তেই আমার দু গাল ভিজিয়ে দিল। কাকুর সাথে ইফা মামার খুব ভাব ছিল। কাকু তখন আমতা আমতা করে বলল, ইফা এসেছিল। ভাল লাগল কেও তাকে দেখতে এসেছিল। কালুপাড়া, বন্দর থেকে দুরের রাস্তা। ওখানে খৃষ্টানদের পেট্রল পোড়ানো মটর সাইকেল খুব সহজে যেতে পারে। বড়দিনে রাস্তায় হারমোনিয়াম, তুমদাক্-এর সুরেলা আওয়াজে গায়ের মেঠোপথ গুলো আন্দোলিত করে তোলে। কিন্তু একটা তরতাজা সম্ভাবনাময় তরুন যখন জীবন সংগ্রামের শুরুর পথে আটকে যায়, সেখানে তখন খু্ব কম মটর সাইকেলের আওয়াজ পাওয়া যায়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কাকু তোমার চিকিৎসার খবর কি?” আমার দিকে এবার ঘৃনা ভরা নয়নে তাকিয়ে থেকে বলল “সব লোক দেথানো, ওরা আমাকে সত্যিকারে সাহায্য করতে আসেনি, কারন আমি তো ওদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। ওরা চাইনি আমি বেঁচে থাকি।” কাকু এক নিঃস্বাসে কথা গুলো বলে থেমে গেল। কাকুর বড় ভাই অনেক কষ্ট করে চিকিৎসা করানোর চেষ্ঠা করছে, গরীব মানুষ কতটুকুই বা পারবে, কাকু’র ভাগের জমি বন্দক দিয়ে তার চিকিৎসা চলছিল। চার্চের লোকেরা ভাল চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই করেনি। স্ট্রকের চিকিৎসা তো ছিল। টাকা থাকলে সেটা তো করা যেত। আর চার্চের টাকার অভাব তো ছিল না। চরম সত্য কথাগুলো কাকু খুব অকপটে বলে দিতে পারতেন। ইলিয়াস মারান্ডী আজ আমাদের মাঝে নেই, আছে তার সত্যি কথা বলার সাহসের উদাহরন। আজকের এই সমাজকে যারা ধর্মের জালে বন্দি করে বিভক্ত করে রেখেছে। সে বেঁচে থাকলে আজকে তাদের মুখোশ আরো খুলে যেত। আজকের সান্তাল সমাজে কেউ যদি সত্যি কথা বলে, তাহলে তাকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে অদৃশ্য ভাবে প্রচন্ড মানুষিক চাপের মধ্যে দাবিয়ে রাখা হয়। কাকু সেই দিন আজকের এই অবস্থার কথা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই তার কলম সেইদিন অকপটে আজকের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিল। আমার সম্পাদনায় “সান্দেস” প্রথম আত্ম প্রকাশ করেছিল। সমাজের কথা বলতে, সংস্কৃতির কথা বলতে, ভাল লাগা, মন্দ লাগা- ভালবাসার কথা বলতে। (চলবে)  

কোন মন্তব্য নেই:

About

Ghonokuasha Baskey is a Santal writer of Bangladesh. He has started writing since 1985.