উত্তরবঙ্গের আদিবাসি খ্রিস্টানরা নিঃগৃহিত
আমার এ লেখাটি পড়ার সাথে সাথে মনে হতে পারে যে, আমি জাতিগত বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছি। আর এই বিষবাষ্প ছড়ানোর অপরাধে আমাকে কেউ কেউ দোষী করলেও করতে পারেন। আমার এ লেখাটিতে খোলা চোখে এ অবধি যা কিছু দেখেছি, সেইটাকেই প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, এই লেখার অনুপ্রেরণা বলতে যদি কোন কিছু থাকে, তাহলে রাজশাহী আদিবাসি খ্রিস্টান হোস্টেল নিয়ে যা কিছু হচ্ছে, সেটারই একটা অনুভুতির প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। (রাজশাহী ক্যাথলিক ডায়সিস খ্রিস্টান ছাত্রাবাস)
আমার বাল্যকাল, পড়াশুনা, ঢাকার অদুরে এক বোডিং স্কুলে, প্রাইমারি থেকে মেট্রিক পর্যন্ত। যেখানে 90 শতাংশ বাঙালী ছাত্রদের আধিক্য। শিক্ষক বলতে আমার সময়ে মান্দি সম্প্রদায় থেকে দু’একজন থাকলেও, উত্তরবঙ্গের আদিবাসিদের থেকে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পর্যন্ত ছিল না। সময়টা যদিও উত্তরবঙ্গের আদিবাসিদের জেগে উঠার সময়গুলোতে ছিল না। তাই সেই সময়টাতে আমি বুঝতে পারিনি, ক্ষমতার জন্য চার্চ পলিটিক্সের ঝাঁঝালো জাতিগত বিদ্বেষের বিষবাষ্পের উত্তাপ। কিন্তু একটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম, আদিবাসিরা খ্রিস্টান সমাজেও কিছুটা হলেও নিচু জাতের প্রজাতি। সেই চার্চের জাতিগত বিভেদের জায়গাটা তুলনামুলক অন্যান্য চার্চ থেকে কম। কারণ সেখানে একটা বিষয় খুব প্রকট আকারে দেখা যেত, তাহলো - আদিবাসি এবং বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। যদিও বোডিং -এ প্রেমের সম্পর্ক ঋৃতু বদলের মতই। তারপরও অনেক প্রেমের সম্পর্ক জীবন-সাথি পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছিল বা এখনও হচ্ছে, তবে অনেক পালাবদলের পর। প্রেমের এই সম্পর্কের বেড়াজালে লুকিয়ে ছিল- একেবারে নিজের করে নেওয়া, একেবারে স্বীয় সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পায়তারা। আর সেই পায়তারা অাজ প্রায় অনেকটাই সফল। আদিবাসি সমাজের অনেক জিনিয়াস আজ প্রায় হারিয়ে গিয়েছে, বাঙালিদের সাথে বিবাহ বন্ধনে অাবদ্ধ হওয়ার জন্যে। আদিবাসি ছেলে-মেয়ে উভয়েই বাঙালিত্বের মাঝে নিজেকে সম্পূর্ণরুপে সর্মপন করেছে। আদিবাসিরা কেউ কোন একজন বাঙালিকে আদিবাসি বানাতে পারেনি, তবে আমার দেখা একটা বিরল ঘটনা ছাড়া। একজন বাঙালী মেয়ে আজ প্রায় পুরোটাই সান্তালি হয়ে গিয়েছে, পরিস্কার সান্তালি ভাষায় কথা বলে, তুখোড় সান্তালি নাচে , সান্তাল কালচারের ডবোক যোহার করে। এটা নিতান্তই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বরং যারা বাঙালি বিয়ে করেছে, তারা প্রায় সবাই আদিবাসি সংস্কৃতি ভুলে বাঙালি হয়ে গিয়েছে। এখানে নিরবে চলেছে, আদিবাসি নিধোনের এক আবেগিক প্রক্রিয়া। এখানে শুধু বাঙালিদের দোষ দিলে বড় অপরাধ হয়ে যাবে। কারণ আমি যদি আমার পথে স্থির থাকি, তাহলে তো অন্যরা অামাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে না। যদিও আমার বিপথগামী হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন: আমি বুঝতে পারিনি, আমি বিপথে চলে যাচ্ছি। কিংবা উপায় নেই, বিয়ে করতে হবে, কিন্তু আমার চার্চের মধ্যে কোন আদিবাসি পাত্র/পাত্রী নেই। তাই বিয়ে করতে হচ্চে কিছুটা নিরুপায় হয়ে।
আমার কাছে মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে, খ্রিস্টানরা এক চার্চ অন্য চার্চের মধ্যে বিয়ের গড়িমসি করে। কিন্তু আমাদের মেয়েরা যখন মুসলমান ছেলেদের সম্পর্ক গড়ে তোলে, তখন চার্চের কোন ব্যক্তিই যেন সেই দিকে নজর দেয় না, জোরালো আপত্তি তোলে না। যাই হোক, এটা নরমের জোম শক্তের ভক্ত।
উত্তরবঙ্গে আদিবাসিদের মধ্যে প্রথম দিকে যে চার্চ গুলো কাজ শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ক্যাথলিক এবং লুথারেন চার্চ। তার পর পরই ব্যাপ্টিস্ট এবং অন্যান্য চার্চ তাদের কাজ শুরু করে। এর মধ্যে শুধুমাত্র সান্তালদের মধ্যে বিশ্বেষায়িত চার্চ হিসেবে লুথারেন চার্চ কাজ করে। কিন্তু সেই চার্চ আজ প্রায় মৃতপ্রায়। এটাও চার্চ পলিটিক্সের নির্মম শিকার, তবে অন্য সম্প্রদায় থেকে বেশী কৌশলে নিগৃহিত হয়েছে বিদেশীদের দ্বারা। আজকের এ অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বিহীন এ চার্চকে পরিচালনা করে আসছিল বলেই , আজ এটা মৃতপ্রায়। আর আদিবাসিদের মধ্যে অন্য সম্প্রদায় এই চার্চের উন্নয়নমুলক সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়াও, চার্চটি মরে যাওয়ার একটা বড় কারণ। তবে এই চার্চ প্রশংসার দাবিদার এই কারণে যে, আজকে সান্তালি ভাষা, সাহিত্য যে পর্যায়ে গিয়েছে, তা এই চার্চের কল্যাণেই। কিন্তু একে টিকিয়ে রাখা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যা কিছু করার দরকার ছিল, তারা সেটা করেননি। (অনার্স পড়ুয়াদের উচেছদে তৎপর কর্তৃপক্ষ)
উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে সমৃদ্ধশীল চার্চ ক্যাথলিক চার্চ। উত্তরবঙ্গের আদিবাসি খ্রিস্টানরা আধিকাংশিই এই চার্চের অধীনে। আজকে উত্তরবঙ্গের আদিবাসিরা শিক্ষা দীক্ষায় যে পর্যায়ে গিয়েছে, তা এই চার্চের কল্যানে। উত্তরবঙ্গের আদিবাসিদের জন্য যে কন্ট্রিবিউশন তা চার্চকে অন্য এক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই কন্ট্রিবিউশনের আড়ালে, অনেক চোখের জল ঝরে আবার শুকিয়েও গিয়েছে। দিনের পর দিন, ক্ষমতায়নের জায়গায় আদিবাসিরা চরমভাবে নিঃগৃহিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গে এই চার্চের ইতিহাস একশ বছরের বেশী, সম্প্রতি সময়ে তারা আদিবাসি সম্প্রদায় থেকে একজন বিশপ বা উচ্চ নীতি নির্ধারক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগের ফলাফল তাদেরকে অনেক বছর পিছিয়ে দিয়েছে। যেটা তারা কোনদিনও রিকোভার করতে পা্রবে না। ভাবতে অবাক লাগে, একশ বছর সময় লেগেছে, আদিবাসিদের মধ্যে থেকে নীতি নির্ধারক তৈরী করতে। কিন্তু তাও আবার নামকাওয়াস্তে। সহজ করে বললে ঠুটো জগন্নাথ। কারণ একজনই সেখানে, কিন্তু তার চারপাশে ছড়িয়ে আছে বাঙালী সম্প্রদায়, যারা তাকে পরিচালনা দেয়। এখানে আর একটি বিষয় বলে রাখা ভাল, আমার মনে হয় চার্চরা কোনভাবেই চায়নি যে, তাদের সদস্যরা এগিয়ে যাক, এটা যেকোন চার্চই হোক না কেন! কেন এমন কথা বলছি? ক্যাথলিক চার্চ এর অনেক বড় বড় নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু সেখানে লক্ষ্য করবেন, উচ্চ পদে কোন আদিবাসি ব্যাক্তি নেই। আপাতত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে যে, আদিবাসিরা নিজেদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। হ্যাঁ, কথাটা হয়ত সত্য। কিন্তু এটাও তো সত্য পারে, তাদেরকে সেই পর্যায়ে যেতে দেওয়া হয়নি। কেন? কারণ এই একশ বছরের ইতিহাসে কি, একজন ব্যক্তিকেও সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি? এই কথাগুলো কি ডাল ভাতের মত গিলতে হবে? না এটা ডাল ভাতের মত গিলার বিষয় নয়, একটা সুক্ষ্ণ রাজনীতি তাদেরকে সেই পর্যায়ে যেতে দেয়নি। এর প্রমান সম্প্রতি রাজশাহী হোস্টেলের ঘটনাগুলো (নগরীতে সংবাদ সম্মেলন আদিবাসী ছাত্রদের নির্যাতনের অভিযোগ )। উচ্চ শিক্ষায় কখনও কোন চার্চই তাদের সদস্যদের অনুপ্রানিত করেনি। বরং সেমিনারী বা ইন্টারমিডিয়েট পড়ার পর ঠেলে দিয়েছে, চার্চের ছোট খাটো কোন চাকুরিতে।
ঘটনা প্রবাহ এখন আর ধর্মের অনুশাসনে আবদ্ধ নেই। এটা ছড়িয়ে পড়েছে, ধর্মের অনেক বাইরে। দীর্ঘ দিনের নিষ্পাষিত মন, আজকে বাইবেলের বাণীতে আটকে থাকছে না। যাদের এই বাণী শিক্ষা দেওয়ার কথা, যাদের এই বাণী নিজেদের পরিপালন করে দেখানোর কথা, তারা সেটা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজকের এই অবস্থার জন্য যারা রাস্তায় নেমে ধর্মের মুখে চুনকালি দিচ্ছে, তারা কোন ভাবেই দোষী হতে পারে না। কারণ যারা তাদেরকে নামতে বাধ্য করেছে, তারাই এর জন্য দায়ী। কি এক নির্মম পরিহাস আজকে যিশুর সেই বাণী, ‘তুমি প্রতিবেশীকে নিজের মত প্রেম কর, ----শত্রুকেই প্রেম কর, --- সে যদি ক্ষুধিত হয়, তাকে আহার করাও, তৃষ্ণার্ত হলে পান করাও।’ এখানে প্রতিবেশীও নয়, নিজের ভ্রাতা, যেটা যিশু সার্টিফাই করে গিয়েছে। একই বিশ্বাসের লোককে নিজের ভাইয়ের চেয়ে আপন বলেছিলেন যিশু। প্রেরিতরা পরবর্তী সময়, একই বিশ্বাসের লোকদেরকে নিজ বাটির পরিজন হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আজকে কি দেখতে পাচ্ছি? তারা নিজেদের ভাইয়ের প্রতি কি করছেন? বিশ্বাসবাটির পরিজনের প্রতি এ কেমন আচরণ? (আদিবাসী ছাত্রদের ওপর নির্যাতন, নীপিড়ন ও বৈষম্যের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম অন্যথায় আন্দোলন)।
ছোট বেলায় শিখেছিলাম, ফল দেখে গাছ চেনা যায়। আজকে ধর্মীয় নেতারা কোন ফল উৎপন্ন করছে? তাদেরকে দেখে কি শিখতে পারছি? কি বুঝতে পারছি? পৃথিবীতে বহু প্রমানিত এই ধর্মকে আজকে তারা অকার্যকর ধর্মে রুপান্তরিত করছে।
উত্তরবঙ্গের আদিবাসিদের মধ্যকার সাংগাঠনিক দূর্বলতার সুযোগে আজ এই বিংশ শতাব্দিতেও আদিবাসিরা নি:গৃহিত। বাঙালীরা খ্রিস্টানরা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার শিখরে অবস্থান করে, আদিবাসিদের কোমর ভাঙ্গার তালে থেকেছে। আজ আদিবাসিরা যখন জেগে উঠার চেষ্টা করছে, তখন ধর্মের মুথে চুনকালি দিয়ে, তা তারা প্রতিহত করছে। বন্ধ হোক এই অনৈতিক, অশাস্ত্রীয় কার্যক্রম। যিশুকে নোংরা রুপে উপস্থান করা থেকে চার্চের কর্তৃপক্ষরা যত তাড়াতাড়ি বিরত হবেন, ততই মঙ্গল। আমরা যিশুর বাণীর ফল দেখতে চাই। আর নিঃগৃহিত নয়, যিশুর ভ্রাতা হিসেবে আদিবসিরা যোগ্যভ্রাতা হিসেবে অবস্থান চায়। আশা করি, কর্তৃপক্ষ সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন