174 টি ভোট = জামানত বাজেয়াপ্ত এবং বাংলাদেশের সান্তাল সমাজ (পর্ব -1)
এ লেখনির প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশের
সান্তাল সমাজকে বিশ্লেষণ করার জন্যে। একবিংশ শতাব্দিতে দাড়িয়ে আমরা কি করছি, সেটা মূল্যায়নের
চেষ্টা করা হয়েছে এ লেখনির মাধ্যমে। লেখনিটির মাধ্যমে খোলাচোখে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে,
বতর্মানে বাংলাদেশের সান্তালরা কেমন আছে?
লেখার প্রারম্ভে কিছু বিষয় বলে
রাখা ভাল। যেমন, বাংলাদেশের সান্তালদের ইতিহাসে সাংগাঠনিক কাঠামো কখনো শক্তভাবে গড়ে
উঠেনি। যুদ্ধের পরবর্তী সময়গুলোতে সরকারের পৃষ্টপোষকতায় কিছু সংস্থা বা সমিতি তৈরী
হয়েছিল কিন্তু সেই জায়গা গুলো থেকে নেতা বা নেতৃত্ব তৈরী হয়নি বা গড়ে উঠেনি। জাতির
জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর 1976 সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর
রহমান আদিবাসি সমাজ উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি আদিবাসি সমিতি তৈরী করে দিয়েছিলেন। সাথে
সাথে কিছু জায়গা দিয়ে সেখানে ছোটখাটো বিল্ডিং করে “আদিবাসি একাডেমী” নাম দিয়ে ছেড়ে
দিয়েছিলেন। সময়ের স্রোতে সেই সময় গুলোতে একাডেমিগুলোতে আদিবাসিদের কিছুটা প্রান চঞ্চল
দেখা গিয়েছিল। সরকারের অনুদানের অনুকুলে কিছু নেতা তৈরী হয়েছিল, সমাজে সেই নেতারা কিছুটা
আশার সঞ্চার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আবার সময়ের স্রোতে সেই নেতারা হারিয়ে গিয়েছিল আবার
কেউ কেউ দূর্নীতির জালে আটকে গিয়ে, সমাজ থেকে দুরে ছিটকে পড়েছিল।
উপরের অংশটুকু, দিনাজপুর জেলা
কেন্দ্রিক। তবে রাজশাহী, নগাঁও এবং অন্যান্য জেলার আদিবাসিদের সাংগাঠনিক পরিধি এবং
ব্যপ্তি কিছুটা ভিন্ন। আর এই ভিন্নতার অন্তরালে এই অঞ্চলের আদিবাসিদের সংগঠনের অন্ত
চরিত্রের মিল প্রায় হুবাহু। তাই আলোচনার স্বার্থে এবং এর সামগ্রিক অবস্থা মানসপটে নিয়ে
আসার লক্ষ্যে, উপরিল্লিখিত স্থানকে আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরে নিয়ে, আসুন আমরা একটু ভিতরে
প্রবেশ করার চেষ্টা করি।
75 এর পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির
প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। 1983 সালের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের মৌলিক জায়গায়
পরিবর্তন এনে, দেশের রাজনীতিটা এবং শাসননীতির মধ্যে অনেকটা বদলে দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে
রাষ্ট্রযন্ত্র মূলনীতি পরিবর্তন করে, ধর্মীয় জায়গাটাতে সরাসরি প্রবেশ করেছিল, ফলে দেশের
অন্যান্য ধর্মাম্বলীদের অবস্থান দেশের মধ্যে নগন্য হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছিল।
মুল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে আর একটি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে
অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নৈতিকভাবে পরবাসি হিসেবে গণ্য করার দিকে পরিচালিত করেছে।
এই প্রেক্ষাপটটি আলোচনার দাবি রাখে এ জন্যে যে, আজকে বাংলাদেশের অন্যান্য জাতি বা সম্প্রদায়
কি অবস্থায় আছে, তা অবলোকন করতে আমাদেরকে সাহায্য করবে।
71 এর পরবর্তীতে এমনিতেই বাংলাদেশের সান্তালরা নিজ দেশে ফিরে এসেও, নিজ দেশের
মত অবস্থা বা আচরণ পায়নি। নয় মাস যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ জীবন দান অবশ্যই দেশের জন্য একটা
বিরাট আত্মহুতি। কিন্তু সেই আত্মত্যাগের সামান্যটুকু সুফল বাংলাদেশের সান্তালরা পায়নি।
কারণ দেশে ফিরে এসেই তারা আবার নতুন করে সহায় সম্পদ হারাতে থাকে। বলা যায় পানির দামে
বিক্রি হতে থাকে তাদের সম্পত্তি। আর এই বিক্রির ময়দানে দলে দলে সামিল হয় প্রায় সমগ্র
সান্তালরা।
জমি বিক্রির এই মিছিলে রাষ্ট্র
কোন ভাবেই এ দিকে নজর দেয়নি। রাষ্ট্র ব্যস্ত ছিল, রাষ্ট্র পূর্ণগঠনে। আর এর মধ্যে বাংলাদেশের
সান্তালরা প্রবেশ করেছিল, অন্য এক সময়ে, অন্য এক পরিস্থিতিতে। যা আগে কখনও এ রকম অভিজ্ঞতা
তারা লাভ করেনি। তারপর কোন এক সময়ে তাদের জমি বিক্রির উপর একটি গেজেট পাশ করা হয়েছিল,
যাতে বলা হয়েছিল, আদিবাসিদের জমি বিক্রি করলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ
করতে হবে। সেই ব্যবস্থা এখনো বহাল আছে, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিরাট রকমের সুভঙ্করের
ফাঁকি লুকিয়ে আছে। ফাঁকির মধ্যে যেমন আদিবাসিদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অনুমতি
আদায়, অন্যত্রে জমি ক্রয় করার অভিপ্রায়ে জমি বিক্রয় এবং সাথে সাথে বেড়ে গিয়েছিল বেনামি
জমি বিক্রয়। এই বেনামে জমি বিক্রয় বিষয় সংক্রান্ত বিষয়টি আমি অনেক দিন পর্যন্ত জানতামই
না, আসলে বিষয়টা কি? পরবর্তীতে অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, বিষয়টি এ রকম—জমি বিক্রয় যেহেতু
আদিবাসিদের নিজেদের মধ্যে সিদ্ধ ব্যবস্থা ছিল, তাই একজন আদিবাসি অন্য একজন আদিবাসির
কাছে বিনা অনুমতিতে জমি বিক্রয় করতে পারে বা সেই রকম ক্ষেত্রে সহসাই অনুমতি পাওয়া যায়।
আর এই সুযোগটি অ-আদিবাসিরা লুফে নেয়। কেউ যদি
জমি বিক্রয় করতে চায়, তাহলে তার জমি একজন আদিবাসির নামে কবলা হবে, কিন্তু টাকা দেবেন
অ-আদিবাসি ব্যক্তি। তারপর এক সময় সেই আদিবাসির কাছ থেকে জমিটি দান কবলা বা নাম মাত্র
মূল্যে কিনবেন সেই অ-আদিবাসি ব্যক্তি। আর এখানে এই রকম পরিস্থিতিতে অনুমতি পাওয়া খুব
কষ্টের বিষয় হয় না। তাছাড়া যে অ-আদিবাসিরা জমি কেনেন, তারা প্রশাসনে এ রকম একটি ব্যবস্থা
করেই রাখেন, যাতে সহজেই অনুমতি লাভ করা যায়। এই সিস্টেমে দেদারসে সান্তালদের জমি বিক্রি
হতে থাকে। আর সান্তালরা তিলে তিলে দিন মজুরের দিকে এগোতে থাকে।
আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত নিচে
নেমে যাওয়ায়, সান্তালরা প্রায় একমুখি হয়ে পড়ে। আর সেই একমুখি দিকটি হচ্ছে-জীবিকা।
জীবিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেদের সংস্কৃতিকে তারা হারিয়ে ফেলে পথিমধ্যে। হারিয়ে ফেলে
সাংস্কৃতির বিরাট ভান্ডার। হারিয়ে ফেলে পঞ্চায়েত এর মত সমৃদ্ধশীল সামাজিক শাসন ব্যবস্থা।
এক সময় এই সামাজিক প্রশাসনিক কাঠামোটি বন্দি হয়ে পড়ে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মঞ্চে। অনুষ্ঠানের
পর্বগুলোতে এর সামান্যতম ব্যবহার, এই ব্যবস্থাকে প্রায় বিলিন করে দিয়েছে। সামাজিকতার মধ্যে শুধু বেচে আছে গ্রাম্য একতার নামে
একটি ঠুনকো লোক দেখানো ব্যবস্থা, যা শুধু অনুষ্ঠানের সময়গুলো কার্যরত থাকে। এই রকম
একটি অবস্থায় সান্তালরা বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক নেতৃত্বের অবকাঠামোর দিকে আসলেই
যেতে পারে কিনা? সেই বিষয়ে পবরর্তি পর্বে আলোচন করা হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন