সান্তালদের ধর্মের উৎস কি? আগের প্রবন্ধে আমরা সান্তালদের "বেদীন" নাম ডিকশনারিতে পেয়েছিলাম এবং সেখানে দেখেছিলাম যারা খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ইসলাম ধর্ম পালন করে না, তাদের "বেদীন" বলা হয়েছে। বর্বর, অসভ্য, ধর্মহীন শব্দগুলোর বিপরীতে খোজার চেষ্টা করছিলাম, কেন সান্তালদের "বেদীন" নামে অভিহিত করা হলো? এর সূত্র ধরেই আমরা সেখান থেকে পাগান নামক শব্দ পেয়েছিলাম এবং এখানে আমরা খুঁজবো সান্তালরা কি পাগান ধর্মের অনুসারী? এখানে বেদীন সান্তালদেরকে "সাঁওতাল" বলে উল্লেখ করছি, কারণ তারা নিজেদেরকে "সাঁওতাল" বলে পরিচয় দিতে ভালবাসে।
পাগান ধর্ম কি?
ইংরেজি ভাষায় প্যাগানিজম শব্দটি, লাতিন পেগানাস থেকে এই পাগান শব্দটি এসেছে। যারা প্যাগানিজম এর অনুশীলন করে তাদের পাগান বলে চিহ্নিত করে। বা যারা পাগান ধর্মের অনুসারে ধর্মচারণ করে তাদের ধর্মকে প্যাগানিজম বলা হয়।
প্যাগানিজমকে উইকিপিডিয়াতে এভাবে বর্ণনা করে "যার অর্থ খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে দাঁড়ায় কোন অ-আব্রাহামীয় ধর্মের কিছু আত্মিক ও সামাজিক আচার ও বিশ্বাস। মূর্তিপূজা বা প্রতিমাপূজা প্যাগানিজমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য|
এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, গ্রেকো রোমান বহুদেববাদ হিসেবে ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের আগে বহু ঈশ্বরবাদী ঐতিহ্যে ব্যবহার করা হয়। ব্যাপক অর্থে, প্রসারিত সমকালীন ধর্মগুলোতে এটি অধিকাংশ পূর্বাঞ্চলীয় ধর্ম এবং আমেরিকা, মধ্য এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার আদিবাসী ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত; এবং সেইসাথে সাধারণভাবে অ-আব্রাহামিক লোকধর্মকেও এটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।"
উপরের বর্ণনা অনুযায়ী সাঁওতালদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে পুরোপুরি মিলে না, যদিও আফ্রিকার আদিবাসীদের ঐতিহ্যের সাথে একে অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ সাঁওতালরা এক ঈশ্বরবাদ বা একজন সৃষ্টিকর্তা আছে এমন বিশ্বাস করে। পক্ষান্তরে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যে গুলো আমাদের নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে, যা পরে আমরা বিবেচনা করব। তার আগে প্যাগানিজম বিষয়টা ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
আগের প্রবন্ধে Marriam Webster ডিকশনারি থেকে Heathen/s এর সংজ্ঞা দেখেছিলাম। এবার আসুন ঐ একই
ডিকশনারি থেকে Pagan বা paganism এর সংজ্ঞা লক্ষ্য করি ঃ
1. : heathen 1; especially : a follower of a polytheistic religion (as in ancient Rome)
2. : one who has little or no religion and who delights in sensual pleasures and material goods : an irreligious or hedonistic person
3. : neo-pagan witches, druids, goddess worshippers, and other pagans in America today — Alice Dowd
১নং এবং ৩ নং সাঁওতালদের সাথে পুরোপুরি মেলা না, তবে ২নং বিষয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
যার সামান্য বা কোন ধর্মীয় কার্যক্রম নাই
সাঁওতালদের ধর্মীয় কার্যক্রম প্রাত্যহিক না, বরং বিভিন্ন সময়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত, বলা যায় বিভিন্ন উৎসবের সময় ধর্মীয় আচার আচরণ গুলো করে থাকে। এই জন্যে সাঁওতালদের ধর্মকে সামান্য ধর্ম পালনকারীদের মধ্যে রাখা যায়। কোন কোন গবেষক মনে করেন যে, সাঁওতালদের উৎসবগুলোই এক সময় ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে।
চিত্ত বিনোদন প্রিয় ও বস্তুবাদীতা
হ্যাঁ সাঁওতালদের জীবন যাত্রার মধ্যে যদি একটি লক্ষ্য করেন, তাহলে প্রতিটা সাঁওতালদের মধ্যে বিনোদন বিষয়টা লক্ষ্য করবেন, হোক সেটা Doṅ Sogoy কিংবা যেকোন উৎসবে তারা প্রচণ্ড ভাবে বিনোদন প্রিয়। এক কথায় বলতে গেলে সাঁওতালরা আমোদপ্রিয় জাতি।
অধার্মিক ও আনন্দবাদী মানুষ
এখানে অধার্মিক মানে কি? ঐ একই ডিকশনারি বলে : neglectful of religion : lacking religious emotions, doctrines, or practices ধর্মের তাচ্ছিল্যতা: ধর্মীয় আবেগের অভাব, তত্ত্বগুলোর, অথবা চর্চায় উদাসীন। George Bernard Shaw বলেন so irreligious that they exploit popular religion for professional purposes আমরা এখানে জোরালো ভাবে not believing in or practicing any religion এই লাইনগুলো সংগ্রহ করি এবং ভাবার চেষ্টা করি, বাক্যগুলো সাঁওতালদের বেলায় প্রয়োগ করা যায় কিনা? একটা বড় কারণ হতে পারে, যেহেতু সাঁওতালরা নিয়মিত বা দৈনন্দিন ধর্মীয় কার্যক্রম করে না, তাই এদেরকে এ রমকটা বলা যেতে পারে। তবে আর যা কিছু হোক সাঁওতালরা আনন্দবাদী মানুষ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, আধুনিক পাগানিজম এর অনেক রকম ধরন আছে এবং এর উৎপত্তি প্রাচীন ব্যবিলন থেকে যা পরবর্তী রোমের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে । যেহেতু এখনকার পাগান ধর্মগুলো অনেক কিছুর সংমিশ্রণের ফলে একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাই একে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমরা সাঁওতালদের ধর্ম কে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি, এটা পাগানের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিনা, কারণ বেদীন শব্দের মানে খুঁজতে গিয়ে আমরা এই পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছি।
এখানে একটা মজার বিষয় আছে, যা পরবর্তীতে আরও একটু আলোচনা করব, তবে এখানেই এটা বলে রাখা ভাল। তাহলো -
সাঁওতালরা কি হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত?
হ্যাঁ, এ রকমটাই মুক্তকোষ উইকিপিডিয়া বলে, "এরা নিজেদেরকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ রচিত মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যিত-ভাবশিষ্য একলব্যের বংশধর ব'লে বিশ্বাস করে এবং তীরচালনাকালে এখনও নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যবহার করে না কারণ তাদের আদিপুরুষ একলব্যকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দান করেছিলেন ।"- কেন এই টানাটানি? সহজ যুক্তিতে আসতে পারি, তাহলো - যখন আপনার কিছু থাকবে না, তখন আপনাকে যে কেউ, যেখানে সেখানে টেনে নিয়ে যাবে- এটাই বাস্তবতা। তবে দীর্ঘদিন থেকে ভারতবর্ষে থাকার দরুন, এখানকার সংস্কৃতির সাথে অনেক কিছুই মিশে গেছে। ধর্মের রীতিনীতির মধ্যেও অনেক কিছু ঢুকে গেছে, যা হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। যেহেতু সাঁওতালরা বর্তমানে খুব জোর দিয়ে দাবী করছে যে, তারা প্রাকৃতিক উপাসক, তাই প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিষের প্রতি তারা পুজা বা বিশ্বাস রাখে। এখানে একটি মজার বিষয় হল, হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে মূর্তি কিংবা প্রাকৃতিক কোন জিনিষকে পুজা করতে নিষেধ ছিল।
যজুর্বেদ – অধ্যায় ৪০- অনুচ্ছেদ ৯ – [ অন্ধতম প্রভিশান্তি ইয়ে অশম্ভুতি মুপাস্তে – যারা অশম্ভুতির পুজা করে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তারা অধিকতর অন্ধকারে পতিত হয় শাম মুর্তির পুজা করে । অশম্ভুতি হল – প্রাকৃতিক বস্তু যেমন- বাতাস,পানি,আগুন । শাম মুর্তি হল – মানুষের তৈরী বস্তু যেমন - চেয়ার ,টেবিল ,মূর্তি ইত্যাদি।]। তাহলে এই পুজা আর্চনা শুরু হল কিভাবে? যেহেতু হিন্দু ধর্ম প্রাচীন ধর্ম, এবং সবার বেদ,গীতা পড়ার অধিকার ছিল না তাই সেই সময়কার কিছু ঋষি মুনির কারনে মুর্তি পুজোর উদ্ভব হয়েছে । ডা. চমনলাল গৌতম তাঁর বিষ্ণুরহস্য বই এর ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘ঋষিগন মুর্তি পুজার প্রচলন করেছেন॥ খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজা শুরু হয়॥১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। [তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া] "তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়।
( তথ্যসূত্রঃ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য,কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৫-৮৭)।"
হিন্দুদের মত দৈনন্দিন জীবনে সাঁওতালদের পূজার প্রচলন নেই, আছে বিভিন্ন উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানে। ফলে এ সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়া সমীচীন যে, হিন্দুদের মধ্যে বসবাস করতে করতে এক সময় এ রকম পূজার প্রচলনগুলো সাঁওতালদের মধ্যে শুরু হয়। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, পৌরনিক কাহিনীগুলোতে তো পূজার প্রচলন ছিল। তবে তাদের জন্যে বলে রাখি, সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীগুলোতে বিশেষ করে সৃষ্টির জায়গায় এ রকম কোন বিষয় নেয়। হিন্দুদের মধ্যে যেমন ঋষিরা প্রকৃতি এবং মানব তৈরি মূর্তি উভয়ের পূজার প্রচলন করেন, ঠিক তেমনি সাঁওতালদের পুজা গুলোও সময়ের বিবর্তনে হিন্দুদের সংস্পর্শে থেকে সাঁওতালদের মধ্যে চলে এসেছে। সাঁওতালদেরকে বৃহৎ পরিসরে হিন্দু ধর্মের অংশ হিসাবে বোদ্ধারা মনে করেন।
সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীঃ
আসুন এবার আমরা সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর দিকে এগোয়। সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীতে মিলিয়ে দেখি, এ ধর্মের উৎপত্তি কোথায়।
১। সৃষ্টিকর্তা বিষয়কঃ
সাঁওতালদের সৃষ্টিকর্তার নাম ঠাকুর জিউ। যাকে ঘিরে সাঁওতাল জাতি সৃষ্টি। ধর্মের মধ্যে এই অংশকে প্রধান অংশ হিসাবে বিবেচনা করা উত্তম। কারণ, সব ধর্মের পার্থক্যগুলো এই জায়গায় বেশ প্রকটমান। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারেঃ একঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের কথা বিবেচনা করুন; তাদের সব কিছুই প্রায় একই রকম কিন্তু আদম ও হবার পাপ করার জায়গায়টা আলাদা, যা পরবর্তীতে এই দুই ধর্মের বিরাট পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে, সাঁওতালদের ধর্মের এই গোঁড়ার জায়গায় আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন আছে, এখান থেকে আমরা হয়ত আবিষ্কার করতে সমর্থ হবো যে, সাঁওতালদের কেন বেদীন বা পাগান ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে।
ঠাকুরজিউঃ
ঠাকুর শব্দ সাঁওতালদের সান্তালি ভাষার শব্দ নয়। এটি ভারতের প্রাচীন শব্দ। তাহলে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর মধ্যে এই শব্দ এলো কি করে? যদি সাঁওতালদের আদি থেকে ধর্ম থাকত, তাহলে এই শব্দ এখানে যুক্ত হওয়ার কথা না। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, এই শব্দ ভারতীয় লোকেদের সংযুক্তি। হ্যাঁ, এটাও হতে পারে। কারণ সনাতন ধর্মের মধ্যে ঠাকুরজিউ শব্দ পাওয়া যায়। যদি তাই হয়, আবার প্রশ্ন তৈরি হবে যে, তাহলে সাঁওতালদের ধর্মের বিষয় অন্য লোকেরা বা অসাওতালরা পরিবর্ধন করেছে? যদিও সাঁওতালরা মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনা করে। আবার কেউ কেউ বর্তমান সময়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে যে, এই ঠাকুরজিউই আসলে মারাংবুরু। আমরা জানি, মারাংবুরু মানে "বৃহৎ পাহাড়", তাহলে কি এই বৃহৎ পাহাড় "সৃষ্টিকর্তা"? এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো - ঠাকুর শব্দের অর্থ "দেবতা" আবার জিউ শব্দের অর্থও "দেব"।
পরবর্তী পর্বে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য করবো।
সাঁওতালরা পুজো করছে |
ইংরেজি ভাষায় প্যাগানিজম শব্দটি, লাতিন পেগানাস থেকে এই পাগান শব্দটি এসেছে। যারা প্যাগানিজম এর অনুশীলন করে তাদের পাগান বলে চিহ্নিত করে। বা যারা পাগান ধর্মের অনুসারে ধর্মচারণ করে তাদের ধর্মকে প্যাগানিজম বলা হয়।
প্যাগানিজমকে উইকিপিডিয়াতে এভাবে বর্ণনা করে "যার অর্থ খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে দাঁড়ায় কোন অ-আব্রাহামীয় ধর্মের কিছু আত্মিক ও সামাজিক আচার ও বিশ্বাস। মূর্তিপূজা বা প্রতিমাপূজা প্যাগানিজমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য|
এটি মূলত একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, গ্রেকো রোমান বহুদেববাদ হিসেবে ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারের আগে বহু ঈশ্বরবাদী ঐতিহ্যে ব্যবহার করা হয়। ব্যাপক অর্থে, প্রসারিত সমকালীন ধর্মগুলোতে এটি অধিকাংশ পূর্বাঞ্চলীয় ধর্ম এবং আমেরিকা, মধ্য এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার আদিবাসী ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত; এবং সেইসাথে সাধারণভাবে অ-আব্রাহামিক লোকধর্মকেও এটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।"
উপরের বর্ণনা অনুযায়ী সাঁওতালদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে পুরোপুরি মিলে না, যদিও আফ্রিকার আদিবাসীদের ঐতিহ্যের সাথে একে অন্তর্ভুক্ত করে। কারণ সাঁওতালরা এক ঈশ্বরবাদ বা একজন সৃষ্টিকর্তা আছে এমন বিশ্বাস করে। পক্ষান্তরে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যে গুলো আমাদের নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে, যা পরে আমরা বিবেচনা করব। তার আগে প্যাগানিজম বিষয়টা ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করি।
আগের প্রবন্ধে Marriam Webster ডিকশনারি থেকে Heathen/s এর সংজ্ঞা দেখেছিলাম। এবার আসুন ঐ একই
ডিকশনারি থেকে Pagan বা paganism এর সংজ্ঞা লক্ষ্য করি ঃ
1. : heathen 1; especially : a follower of a polytheistic religion (as in ancient Rome)
2. : one who has little or no religion and who delights in sensual pleasures and material goods : an irreligious or hedonistic person
3. : neo-pagan witches, druids, goddess worshippers, and other pagans in America today — Alice Dowd
১নং এবং ৩ নং সাঁওতালদের সাথে পুরোপুরি মেলা না, তবে ২নং বিষয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
যার সামান্য বা কোন ধর্মীয় কার্যক্রম নাই
সাঁওতালদের ধর্মীয় কার্যক্রম প্রাত্যহিক না, বরং বিভিন্ন সময়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত, বলা যায় বিভিন্ন উৎসবের সময় ধর্মীয় আচার আচরণ গুলো করে থাকে। এই জন্যে সাঁওতালদের ধর্মকে সামান্য ধর্ম পালনকারীদের মধ্যে রাখা যায়। কোন কোন গবেষক মনে করেন যে, সাঁওতালদের উৎসবগুলোই এক সময় ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে।
চিত্ত বিনোদন প্রিয় ও বস্তুবাদীতা
হ্যাঁ সাঁওতালদের জীবন যাত্রার মধ্যে যদি একটি লক্ষ্য করেন, তাহলে প্রতিটা সাঁওতালদের মধ্যে বিনোদন বিষয়টা লক্ষ্য করবেন, হোক সেটা Doṅ Sogoy কিংবা যেকোন উৎসবে তারা প্রচণ্ড ভাবে বিনোদন প্রিয়। এক কথায় বলতে গেলে সাঁওতালরা আমোদপ্রিয় জাতি।
অধার্মিক ও আনন্দবাদী মানুষ
এখানে অধার্মিক মানে কি? ঐ একই ডিকশনারি বলে : neglectful of religion : lacking religious emotions, doctrines, or practices ধর্মের তাচ্ছিল্যতা: ধর্মীয় আবেগের অভাব, তত্ত্বগুলোর, অথবা চর্চায় উদাসীন। George Bernard Shaw বলেন so irreligious that they exploit popular religion for professional purposes আমরা এখানে জোরালো ভাবে not believing in or practicing any religion এই লাইনগুলো সংগ্রহ করি এবং ভাবার চেষ্টা করি, বাক্যগুলো সাঁওতালদের বেলায় প্রয়োগ করা যায় কিনা? একটা বড় কারণ হতে পারে, যেহেতু সাঁওতালরা নিয়মিত বা দৈনন্দিন ধর্মীয় কার্যক্রম করে না, তাই এদেরকে এ রমকটা বলা যেতে পারে। তবে আর যা কিছু হোক সাঁওতালরা আনন্দবাদী মানুষ, এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল, আধুনিক পাগানিজম এর অনেক রকম ধরন আছে এবং এর উৎপত্তি প্রাচীন ব্যবিলন থেকে যা পরবর্তী রোমের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে । যেহেতু এখনকার পাগান ধর্মগুলো অনেক কিছুর সংমিশ্রণের ফলে একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাই একে খুব সহজে ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমরা সাঁওতালদের ধর্ম কে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি, এটা পাগানের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিনা, কারণ বেদীন শব্দের মানে খুঁজতে গিয়ে আমরা এই পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছি।
সারসংক্ষেপ আধুনিক পাগান ধর্মকে এভাবে বলতে পারিঃ
- গঠন ঃ পরম্পরাগত ভাবে চলে আসা বিভিন্ন ধর্মের রীতিনীতি আচার অনুষ্ঠান যা ২০ শতকে এসে বিভিন্ন জাতি এখান থেকে উপাদানগুলো নিয়ে নিজেদের ধর্মের অবয়ব তৈরি করেছে।
- উৎস ঃ পাগান ধর্ম অনেক বৈচিত্র্যের মিলন, এখানে পৌরনিক কাহিনী আছে, ইতিহাস আছে, খ্রিস্টীয় পূর্ব সময়ের বিভিন্ন উৎস থেকে আগত, সাথে সাথে ইউরোপীয় বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে গৃহীত।
- অনুসারী ঃ অনেক জটিল কিছুর মিশ্রণের মতই এর মিশ্রণ হওয়ার ফলে, এর অনুসারীদের এককভাবে আলাদা করা কঠিন, তবে পৌত্তলিকতার মধ্যে এদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
এখানে একটা মজার বিষয় আছে, যা পরবর্তীতে আরও একটু আলোচনা করব, তবে এখানেই এটা বলে রাখা ভাল। তাহলো -
সাঁওতালরা কি হিন্দু ধর্মের অন্তর্গত?
হ্যাঁ, এ রকমটাই মুক্তকোষ উইকিপিডিয়া বলে, "এরা নিজেদেরকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ রচিত মহাভারতে বর্ণিত কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যিত-ভাবশিষ্য একলব্যের বংশধর ব'লে বিশ্বাস করে এবং তীরচালনাকালে এখনও নিজেদের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যবহার করে না কারণ তাদের আদিপুরুষ একলব্যকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দান করেছিলেন ।"- কেন এই টানাটানি? সহজ যুক্তিতে আসতে পারি, তাহলো - যখন আপনার কিছু থাকবে না, তখন আপনাকে যে কেউ, যেখানে সেখানে টেনে নিয়ে যাবে- এটাই বাস্তবতা। তবে দীর্ঘদিন থেকে ভারতবর্ষে থাকার দরুন, এখানকার সংস্কৃতির সাথে অনেক কিছুই মিশে গেছে। ধর্মের রীতিনীতির মধ্যেও অনেক কিছু ঢুকে গেছে, যা হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। যেহেতু সাঁওতালরা বর্তমানে খুব জোর দিয়ে দাবী করছে যে, তারা প্রাকৃতিক উপাসক, তাই প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিষের প্রতি তারা পুজা বা বিশ্বাস রাখে। এখানে একটি মজার বিষয় হল, হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে মূর্তি কিংবা প্রাকৃতিক কোন জিনিষকে পুজা করতে নিষেধ ছিল।
যজুর্বেদ – অধ্যায় ৪০- অনুচ্ছেদ ৯ – [ অন্ধতম প্রভিশান্তি ইয়ে অশম্ভুতি মুপাস্তে – যারা অশম্ভুতির পুজা করে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তারা অধিকতর অন্ধকারে পতিত হয় শাম মুর্তির পুজা করে । অশম্ভুতি হল – প্রাকৃতিক বস্তু যেমন- বাতাস,পানি,আগুন । শাম মুর্তি হল – মানুষের তৈরী বস্তু যেমন - চেয়ার ,টেবিল ,মূর্তি ইত্যাদি।]। তাহলে এই পুজা আর্চনা শুরু হল কিভাবে? যেহেতু হিন্দু ধর্ম প্রাচীন ধর্ম, এবং সবার বেদ,গীতা পড়ার অধিকার ছিল না তাই সেই সময়কার কিছু ঋষি মুনির কারনে মুর্তি পুজোর উদ্ভব হয়েছে । ডা. চমনলাল গৌতম তাঁর বিষ্ণুরহস্য বই এর ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘ঋষিগন মুর্তি পুজার প্রচলন করেছেন॥ খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজা শুরু হয়॥১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। [তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া] "তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়।
( তথ্যসূত্রঃ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য,কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ২৮৫-৮৭)।"
হিন্দুদের মত দৈনন্দিন জীবনে সাঁওতালদের পূজার প্রচলন নেই, আছে বিভিন্ন উৎসব কিংবা অনুষ্ঠানে। ফলে এ সিদ্ধান্তে
আধুনিক সাঁওতালরা এ রকম পূজারও প্রচলন করেছে |
সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীঃ
আসুন এবার আমরা সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর দিকে এগোয়। সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীতে মিলিয়ে দেখি, এ ধর্মের উৎপত্তি কোথায়।
১। সৃষ্টিকর্তা বিষয়কঃ
সাঁওতালদের সৃষ্টিকর্তার নাম ঠাকুর জিউ। যাকে ঘিরে সাঁওতাল জাতি সৃষ্টি। ধর্মের মধ্যে এই অংশকে প্রধান অংশ হিসাবে বিবেচনা করা উত্তম। কারণ, সব ধর্মের পার্থক্যগুলো এই জায়গায় বেশ প্রকটমান। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারেঃ একঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের কথা বিবেচনা করুন; তাদের সব কিছুই প্রায় একই রকম কিন্তু আদম ও হবার পাপ করার জায়গায়টা আলাদা, যা পরবর্তীতে এই দুই ধর্মের বিরাট পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে, সাঁওতালদের ধর্মের এই গোঁড়ার জায়গায় আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন আছে, এখান থেকে আমরা হয়ত আবিষ্কার করতে সমর্থ হবো যে, সাঁওতালদের কেন বেদীন বা পাগান ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে।
ঠাকুরজিউঃ
ঠাকুর শব্দ সাঁওতালদের সান্তালি ভাষার শব্দ নয়। এটি ভারতের প্রাচীন শব্দ। তাহলে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর মধ্যে এই শব্দ এলো কি করে? যদি সাঁওতালদের আদি থেকে ধর্ম থাকত, তাহলে এই শব্দ এখানে যুক্ত হওয়ার কথা না। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, এই শব্দ ভারতীয় লোকেদের সংযুক্তি। হ্যাঁ, এটাও হতে পারে। কারণ সনাতন ধর্মের মধ্যে ঠাকুরজিউ শব্দ পাওয়া যায়। যদি তাই হয়, আবার প্রশ্ন তৈরি হবে যে, তাহলে সাঁওতালদের ধর্মের বিষয় অন্য লোকেরা বা অসাওতালরা পরিবর্ধন করেছে? যদিও সাঁওতালরা মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনা করে। আবার কেউ কেউ বর্তমান সময়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে যে, এই ঠাকুরজিউই আসলে মারাংবুরু। আমরা জানি, মারাংবুরু মানে "বৃহৎ পাহাড়", তাহলে কি এই বৃহৎ পাহাড় "সৃষ্টিকর্তা"? এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, তাহলো - ঠাকুর শব্দের অর্থ "দেবতা" আবার জিউ শব্দের অর্থও "দেব"।
পরবর্তী পর্বে সাঁওতালদের পৌরনিক কাহিনীর আরও কিছু বিষয় লক্ষ্য করবো।